▌ফিকহি মাযহাব নিয়ে গোঁড়ামি এবং ইজতিহাদের শর্ত বিষয়ে কঠোরতা..

ফিকহি মাযহাব নিয়ে গোঁড়ামি এবং ইজতিহাদের শর্ত বিষয়ে কঠোরত
·রচয়িতা: ফাদিলাতুশ শাইখ ড. আব্দুল আযিয বিন রঈস আর-রঈস
[এই নিবন্ধ বোঝার জন্য ইজতিহাদের পরিচয় ও তার শর্তাবলি সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। যেসব পাঠকের বিষয়টি জানা নেই, তাঁদেরকে আমরা “আলিম কে?” শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ার জন্য রেকমেন্ড করছি। নিবন্ধের লিংক: https://tinyurl.com/5jnukvm3। – সম্পাদক]

·পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। আপনাদের জন্য ধার্য হোক আল্লাহপ্রদত্ত নিরাপত্তা এবং আপনাদের ওপর বর্ষিত হোক তাঁর রহমত। অতঃপর:

ফিকহি মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামি রাখা লোকেরা ইজতিহাদের শর্তের ব্যাপারগুলো কঠিন করার চেষ্টা করছে। যাতে তারা একজন ফকিহকে (ইসলামি আইনশাস্ত্রের বিদ্বানকে) ফিকহি মাযহাবগুলো সার্বক্ষণিক ধারণ করে থাকতে বাধ্য করতে পারে। এই দলিলের ভিত্তিতে যে, তারা মুজতাহিদ নয়, সুতরাং তাদের জন্য মাযহাব থেকে বের হয়ে যাওয়া জায়েজ নয়। যে বের হয়ে যাবে, সে পাপী হবে এবং আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে অপরাধকারী বিবেচিত হবে।

বস্তুত তাদের একটি দল ইজতিহাদের দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। অপর একটি দল ইজতিহাদের শর্তকে কঠিন করে তুলেছে। এমনকি ইজতিহাদের অনুমোদনকে ফকিহদের মধ্যে অস্তিত্বহীন এবং আলিমদের মধ্যে অসম্ভব বানিয়ে ফেলেছে। অথচ চার মাযহাবের মুহাক্কিক উলামাগণ এই সংশয় ও তার অসারতা উন্মোচন করার জন্য এবং এর ভ্রষ্টতা ও অনিষ্ট বর্ণনা করার জন্য চেষ্টাপ্রচেষ্টা করেছেন।
·
তাঁরা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন, কোনোরূপ বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা করতেন না। তারা ইজতিহাদের কলকব্জা ছাড়া (অর্থাৎ ইজতিহাদ করার যোগ্যতা ছাড়াই) যেমন কোনো মতকে অগ্রাধিকারযোগ্য আখ্যা দেওয়াকে স্বীকৃতি দিতেন না; যা মূলত দ্বীনের মধ্যে নিরর্থক কাজের শামিল। অপরদিকে তাঁরা ইজতিহাদের শর্তের ব্যাপারগুলো এত কঠিন করতেন না, যেন তাঁরা ইজতিহাদের দ্বার বন্ধ করে ফেলছেন, কিংবা বন্ধ করে ফেলার উপক্রম করছেন। তাঁরা বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি ইজতিহাদের সকল কলকব্জা (tools) হাসিল করেছে—আর ইজতিহাদের কলকব্জার মধ্যে আমলগত ফিকহের মূলনীতিশাস্ত্র (উসুলুল ফিকহ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এবং সেসব নিয়ে অনুশীলন করেছে, তারই ইজতিহাদ করার অধিকার আছে।

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “আর এই কিতাবগুলোতে যে দুটো বর্ণনা এবং দুটো দিক উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে কোনটা সহিহ তার উল্লেখ নেই; সেক্ষেত্রে তালিবুল ইলমের জন্য অন্য কোনো কিতাব থেকে সহিহ বর্ণনাটি জেনে নেওয়া সম্ভব। যেমন কাদি আবু ইয়া‘লা বিরচিত কিতাবুত তা‘লিক। তালিবুল ইলমের কাছে শরিয়তের দলিলপ্রমাণ সম্বন্ধে এর জ্ঞান থাকলে, সে শরিয়তে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় কোনটি তা চিনে নিতে পারবে।” [মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ২২৭]

তিনি এখানে ইজতিহাদের বিষয়টিকে কঠিন করেননি। বরং একজন তালিবুল ইলমের জন্যও ইজতিহাদের বৈধতা দিয়েছেন।
·
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ সালাফদের কথা বর্ণনা করে বলেন, “তাঁরা (সালাফরা) আলিমদের জন্য ইজতিহাদের দরজা খুলে দিয়েছেন, তারা আলেমদের জন্য পথ বলে গেছেন এবং তাদের জন্য তাদের পথের বিবরণ দিয়েছেন।” [ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৮৩]

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “অন্য একটি দল দাবি করেছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন আবু আমর ইবনুস সালাহ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু হামাদান, যে ব্যক্তি তার মাযহাবের বিপরীতে কোনো হাদিস পায়, তারমধ্যে যদি নিরঙ্কুশ ইজতিহাদের কলকব্জা পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে (সে যদি মুজতাহিদ মুতলাক হয়ে থাকে), অথবা তদীয় ইমামের মাযহাবে ইজতিহাদ করার মতো যোগ্যতা থাকে, অথবা সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ের মাসায়েলে ইজতিহাদ করার মতো যোগ্যতা থাকে, কিংবা স্রেফ ওই একটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে তাঁর ইজতিহাদ করার মতো যোগ্যতা থাকে, তাহলে উক্ত (মাযহাব-পরিপন্থি) হাদিস অনুযায়ী আমল করাই উচিত হবে।

পক্ষান্তরে তার নিকটে যদি ইজতিহাদের কলকব্জা পূর্ণরূপে না থাকে, তথাপি গবেষণা করে সে উক্ত হাদিসের পরিপন্থি আমল করার জন্য কোনো সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ার দরুন অন্তরে ব্যথা অনুভব করে, তাহলে সে লক্ষ করবে, উক্ত হাদিস অনুযায়ী কোনো স্বতন্ত্র ইমাম আমল করেছেন কিনা। যদি সে কোনো ইমামকে এই হাদিসের ওপর আমল করতে দেখতে পায়, তাহলে সে উক্ত হাদিস অনুযায়ী আমল করার জন্য ওই (ভিন্ন মাযহাবের) ইমামের মত গ্রহণ করবে। আর এটা তার জন্য নিজের ইমামের মাযহাব ত্যাগ করার ক্ষেত্রে একটি ওজর হবে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।” [ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৬৬]
·
তাঁর এই কথাটির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ করুন—‘যে ব্যক্তির নির্দিষ্ট ওই একটি হাদিসের ক্ষেত্রেও ইজতিহাদ করার মতো সক্ষমতা আছে (তার জন্যও নিজের মাযহাব ছেড়ে উক্ত হাদিস অনুযায়ী আমল করাই বাঞ্ছনীয় হবে)।’

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “ইজতিহাদ এমন একটি স্তর, যা বিভাজন ও বিভক্তি গ্রহণ করে। সুতরাং একজন মানুষ কোনো একটি শাস্ত্রে মুজতাহিদ হওয়ার পাশাপাশি অন্য শাস্ত্রে মুকাল্লিদও (বিনা দলিলে অনুসরণকারীও) হতে পারে। কিংবা একজন ব্যক্তি কোনো একটি অধ্যায়েও মুজতাহিদ হতে পারে। যেমন কেউ স্রেফ ফারায়েজ শাস্ত্রে (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয় একটি ইসলামি শাস্ত্র), এ সংক্রান্ত দলিলপ্রমাণ এবং কিতাব ও সুন্নাহ থেকে সেগুলো উদ্‌ঘাটন করার ক্ষেত্রে নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যয় করেছে, অন্য কোনো শাস্ত্রে তা করেনি। অথবা জিহাদ, হজ বা অন্য কোনো অধ্যায়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছে।

এরকম ব্যক্তির জন্য ইজতিহাদ করেনি এমন বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে বিষয়ে ইজতিহাদ করেছে, সে বিষয়ক জ্ঞানের উপস্থিতি তার জন্য ফতোয়াদানের বৈধতা করে দেবে না ওই জাতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে, যেসব বিষয়ে তার ইলম নেই। তবে যেই বিষয়ে সে ইজতিহাদ করেছে, সেই বিষয় সম্পর্কে কি সে ফতোয়া দিতে পারবে? এক্ষেত্রে তিনটি অভিমত আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে সঠিক অভিমত—এটা জায়েজ; বরং এটা সুনিশ্চিত সঠিক।

অতঃপর তিনি আরও বলেন, জায়েজ বা বৈধতার পক্ষে দলিল হলো— নিশ্চয় সে (অর্থাৎ যিনি ফতোয়া দিবেন) অবশ্যই দলিল-সহ সত্য জেনেছেন। তিনি সঠিকটা জানার জন্য স্বীয় প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। অতএব ওই একটি বিষয়ে তার হুকুম হবে সকল বিষয়ে মুজতাহিদ মুতলাকের হুকুমের মতো।” [ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১২৯]
·
যারা ধারণা করে, ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, তাদেরকে রদ করতে গিয়ে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কখন ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হবে, এ বিষয়ে তারা অসংখ্য অভিমতে মতদ্বৈধতা করেছিল, যেসব মতের পক্ষে আল্লাহ কোনো দলিল অবতীর্ণ করেননি। তাদের মতে আল্লাহর জন্য দলিল-সহ প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি পৃথিবীতে নেই। ইলম সহকারে কথা বলবে এমন কোনো ব্যক্তি জমিনে অবশিষ্ট নেই। আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাতকে দেখার পর কারো জন্যই বৈধ নয় এ দুটো থেকে হুকুম-আহকাম গ্রহণ করা। এমনকি কিতাব-সুন্নাহ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেওয়া ও ফতোয়া দেওয়াও জায়েজ নয়, যতক্ষণ না সে বিষয়টিকে তার কাছে পেশ করছে, যে ব্যক্তির তাকলিদ ও অনুসরণ সে করে থাকে!

যদি কিতাব-সুন্নাহর কথা ওই অনুসৃত বিদ্বানের কথার সাথে মিলে যায়, তাহলে সে তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। আর না মিললে কিতাব-সুন্নাহর কথা সে প্রত্যাখ্যান, তা মেনে নেবে না! তুমি দেখতে পাচ্ছ, এই কথাগুলা বিনষ্টি, বাতিল হওয়া, পরস্পরবিরোধী হওয়া, আল্লাহর ব্যাপারে বিনা ইলমে কথা বলা, আল্লাহর দলিলপ্রমাণকে বাতিল সাব্যস্ত করা, আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাতের ব্যাপারে এবং তা থেকে হুকুম-আহকাম গ্রহণ করার ব্যাপারে অনাগ্রহী হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে! আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরকে পূর্ণতা দেবেন এবং তাঁর রসুলের এ বাণীকে সত্যায়ন করবেন যে, ‘জমিনে সর্বদাই আল্লাহর জন্য দলিল-সহ সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বিদ্যমান থাকবে।’

সর্বদাই নবির উম্মতের একটি দল নির্ভেজাল হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, যে নবিকে আল্লাহ হক সহকারে প্রেরণ করেছেন। আর সর্বদাই এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীতে এমন এক ব্যক্তি প্রেরিত হবেন, যিনি দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন। এসব বক্তব্য ভ্রান্ত হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে যে, এসব বক্তব্যের প্রবক্তাদের বলতে হবে—তোমরা যাদের নাম উল্লেখ করার পর বলছ, এদের পরবর্তীতে আর কাউকে তাকলিদ করার জন্য চয়ন করতে পারবে না কেউ; তাহলে বল, অন্যদের বাদ দিয়ে এদেরকেই তাকলিদ করার জন্য বেছে নেওয়ার অধিকার তোমাদের কাছে কোত্থেকে আপতিত হয়েছে?!” [ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩২]
·
ইবনুল ওয়যীর রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-ক্বাওয়ায়েদ কিতাবে বলেন, “জেনে রাখ, অধিকাংশ মানুষই এই জামানায় ইজতিহাদকে বড়ো মনে করে। তারা ইজতিহাদ থেকে দূরে থাকতে চায়। অবশেষে ইজতিহাদ তাদের কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সালাফগণ ইজতিহাদের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করেননি। তবে বিষয়টি সহজও নয়। বরং তা ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন, সঠিক বিবেচনাবোধ এবং নির্বুদ্ধিতার আপদ থেকে বেঁচে থাকার নিকটবর্তী।” [সানআনি কৃত ইরশাদুন নুক্কাদ ইলা তাইসিরিল ইজতিহাদ, পৃষ্ঠা: ৬০]

শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ তদীয় উসুলুস সিত্তাহ পুস্তিকায় বলেছেন, “কুরআন ও সুন্নাহ বর্জন করা এবং নানাবিধ দলাদলি আনয়নকারী বিদাত ও প্রবৃত্তিজাত মতাদর্শের অনুসরণ করার জন্য শয়তান যে সংশয় তৈরি করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। শয়তানের তৈরিকৃত সংশয় হলো—নিরঙ্কুশ মুজতাহিদ ছাড়া কুরআন-সুন্নাহ কেউ বুঝতে সক্ষম নয়। আর মুজতাহিদকে এরূপ এরূপ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে হবে, হয়তো দেখা যাবে এসব বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় আবু বকর ও ওমরের মধ্যেও নেই! সুতরাং মানুষ যদি এরূপ (বৈশিষ্ট্যের অধিকারী) না হয়, তাহলে কুরআন-সুন্নাহ থেকে তাকে বিমুখ হতে হবে; যা আবশ্যকীয় ফরজ বিধান, এতে কোনো সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহয় হেদায়েত অনুসন্ধান করবে, সে হয় ধর্মত্যাগী, আর নয়তো উন্মাদ; কারণ কুরআন-সুন্নাহ দুর্বোধ্য জটিল। আল্লাহর প্রশংসা সহকারে তাঁকে ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করছি। আল্লাহ শরয়ি ও সৃষ্টিগতভাবে কতবারই না এই অভিশপ্ত সংশয়কে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ডন করেছেন, ফলে তা সার্বজনিক জরুরি বিষয়াদির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানে না।”
·
শাইখ সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ তাঁর তাইসিরুল আযিযিল হামিদ গ্রন্থে (পৃ. ৪৭২) বলেছেন, “আহমাদের উদ্দেশ্য ওই ব্যক্তির বিরোধিতা করা, যে হাদিসের সনদ ও তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। এ সত্ত্বেও সে সুফিয়ান বা অন্য কারও অন্ধ-অনুকরণ করে, আর নানাবিধ বাতিল ওজর-আপত্তি পেশ করে থাকে। হয় এরকম ওজর দেয় যে, বহুযুগ আগেই ইজতিহাদ বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা ওজর দেয়, আমি যে ইমামের অনুকরণ করেছি সে আমার থেকে বেশি জ্ঞানী। কেননা তিনি ইলম ব্যতীত কথা বলেন না। তদ্রুপ ইলম ছাড়া তিনি হাদিসও ত্যাগ করেন না। কিংবা ওজর দেয়, এটা ইজতিহাদ। আর ইজতিহাদকারী মুজতাহিদের ব্যাপারে শর্ত হলো, আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাহ বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন থাকতে হবে। নাসেখ মানসুখ জানা থাকতে হবে। সুন্নাতের (বা হাদিসের সনদের) বিশুদ্ধতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। দলিলের নানাবিধ মর্ম বিষয়ে জানা থাকতে হবে। আরবি ভাষা, ব্যাকরণ ও উসুল (মূলনীতি) সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। আর এমনসব শর্ত যেগুলো পুরোপুরি আবু বকর ও ওমর রাদিআল্লাহু আনহুমার মধ্যেও না থাকতে পারে। যেমনটি লেখক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন।

তাঁকে বলতে হবে, তাদের কথা যদি সঠিক হয়, তবে তাদের এসব শর্তারোপের উদ্দেশ্য নিরঙ্কুশ মুজতাহিদ। পক্ষান্তরে এগুলো যদি কুরআন সুন্নাহর প্রতি আমলের বৈধতার শর্ত হয়, তাহলে এটা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার এবং বিদ্বান ইমামগণের বিরুদ্ধেও মিথ্যা অপবাদ। বরং মুমিনের ওপর অত্যাবশ্যক হলো যখন তার কাছে আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাতের জ্ঞান পৌঁছে, তখন এটার ওপরই আমল করবে, যে ব্যক্তির অভিমতই এর বিপরীতে যাক না কেন। আমাদের রব এবং আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্দেশনাই দিয়েছেন। আর সকল আলেমই এই বিষয়ে একমত হয়েছে, কিছু মূর্খ মুকাল্লিদ ছাড়া। আর এসব মুকাল্লিদরা আহলুল ইলমদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আবু ওমর ইবনু আব্দিল বার্র এবং অন্যান্যরা এই ব্যাপারে ইজমা বর্ণনা করেছেন যে, তারা (মুকাল্লিদরা) আলেমগণের অন্তর্ভুক্ত নয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের ওপর তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করো, এ ছাড়া অন্য কোনো অভিভাবকের অনুসরণ করো না। (সুরা আরাফ: ৩)”

·শাইখ আব্দুর রহমান বিন হাসান রাহিমাহুল্লাহ তদীয় ফাতহুল মাজিদ গ্রন্থে (পৃ. ৩৮৭) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের কল্যাণকামনা করে, তার উচিত যখন সে আলেমদের কিতাব অধ্যয়ন করবে এবং তাঁদের বক্তব্য জানতে পারবে, তখন সে তাঁদের কথাকে কিতাব ও সুন্নাহর কাছে পেশ করবে। কেননা প্রত্যেক মুজতাহিদই আলেমগণের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করে এবং তার মাযহাবের দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, তাহলে সে অবশ্যই তার দলিল উল্লেখ করবে।

আর একটি মাসয়ালায় হক্ব একটিই। যদিও ইমামগণ তাঁদের ইজতিহাদের দরুন সওয়াব পাবেন। অতএব মুজতাহিদগণের বক্তব্য নিয়ে কৃত চিন্তা ও গবেষণাকে একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি মাসআলা জানা, অন্তরে সেসব মাসআলা দ্রুত হাজির করা এবং মুজতাহিদগণ যে দলিল দেন সেসবের আলোকে ভুল থেকে সঠিককে নিরূপিত করার মাধ্যম বানিয়ে নেবে। আর এভাবেই সে জানতে পারবে, উলামাদের মধ্যে কার অভিমত দলিলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। এরপর সে তাঁর অনুসরণ করবে। এই মূলনীতি নিয়ে কুরআন-সুন্নাহয় অগণিত দলিল রয়েছে।”
·
শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমিন তাঁর আদ্বওয়াউল বায়ান গ্রন্থে (৭/২৫৮) বলেছেন, “জেনে রাখ, পরবর্তী যুগের কতিপয় উসুলবিদগণের কথা হলো, মুজতাহিদগণ ছাড়া এই মহান কুরআন গভীরভাবে চিন্তা করা, তা বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা কারও জন্য জায়েজ নয়। প্রত্যেক যে ব্যক্তি সুনির্ধারিত শর্তের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ ইজতিহাদের পর্যায়ে পৌঁছেনি তাহলে পরবর্তী যুগের উসুলবিদগণের মতে সে ব্যক্তির জন্য উক্ত কাজ না-জায়েজ। আর তাদের নির্ধারিত শর্তাবলির অনেকগুলোর ব্যাপারেই কিতাব, সুন্নাহ, ইজমা, সুস্পষ্ট ক্বিয়াস থেকে এমনকি সাহাবাদের আসার থেকেও দলিল নেই। মূলত এ ব্যাপারে কোনো শরয়ি দলিলের ভিত্তিই নেই।

বরং নিঃসন্দেহ সত্য হচ্ছে, যে মুসলিমেরই শিক্ষাগ্রহণ করার ও বুঝার ক্ষমতা রয়েছে, কুরআন এবং সুন্নাহর অর্থ বোঝার ক্ষমতা রয়েছে, তাদের জন্য কুরআন সুন্নাহর শিক্ষাগ্রহণ করা এবং সে জ্ঞান অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। অজ্ঞতা নিয়ে এ দুয়ের প্রতি আমল করা সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে সে কুরআন সুন্নাহ থেকে নতুন যে সঠিক জ্ঞান শিখেছে, তাকে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে; একটি আয়াত কিংবা একটি হাদিস হলেও। আর জ্ঞাত বিষয় হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না, তার ব্যাপারে বর্ণিত নিন্দা ও তিরস্কার সকল মানুষের জন্যই ব্যাপক।

এ থেকেও বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রথমদিকে যাদের সম্বোধন করে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তারা ছিল মুনাফেক ও কাফের সম্প্রদায়। উসুলবিদগণের মতে তাদের কারও মাঝে পরিপূর্ণভাবে ইজতিহাদের শর্ত ছিল না। বরং তাদের কাছে এসব শর্তের কোনোকিছুই ছিল না। কুরআন অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে উপকৃত হওয়া যদি জায়েজ না হয় এবং হেদায়েত অন্বেষণ না করা যায়, তাহলে আল্লাহ কুরআন পড়েও হেদায়েত না হওয়ার দরুন কাফেরদের ভর্ৎসনা করতেন না। তোমার দেখা উসুলবিদগণের নিকটে নির্ধারিত ইজতিহাদের শর্তগুলো অর্জন না পর্যন্ত তাদের ওপর হুজ্জত (দলিল) কায়েম করতেন না।”
·
শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমিন তাঁর আদ্বওয়াউল বায়ান গ্রন্থে (৭/২৬২) আরও বলেছেন, “কেয়ামতের দিন তার প্রভুর কাছে মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা করে এমন প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এই মহা বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে যে বিরাট বিপর্যয় নেমে এসেছে তা থেকে উত্তরণের পথ তালাশের লক্ষ্যে চিন্তা-ফিকির করা। (আর যে বিপর্যয়টা নেমে এসেছে) সেটা হচ্ছে কুরআন সুন্নাহ থেকে প্রয়োজনমুক্ত হওয়ার দাবি করার দরুন। সুরক্ষিত মাযহাবগুলোর মাধ্যমে সকল প্রকার হুকুম-আহকাম, ইবাদত, লেনদেন, দণ্ডবিধি এবং অন্যান্য বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ থেকে পুরোপুরি প্রয়োজনমুক্ত মনে করা এ বিপর্যয়ের কারণ।
আর এই (বিপর্যয়) দুইটি ভিত্তির ওপর গঠিত:
১. মুজাতাহিদ ছাড়া (অন্য কারও জন্য) কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমল করা জায়েজ নয়।
২. নিশ্চয় মুজতাহিদগণের কোনো অস্তিত্ব নেই। মুজতাহিদদের মধ্য থেকে কেউই দুনিয়াতে বিদ্যমান নেই।
এই দুটো ভিত্তির আলোকেই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করা সকল জমিনবাসীর জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করা হয় এবং মাযহাবের মাধ্যমে কুরআন সুন্নাহ থেকে প্রয়োজনমুক্ত মনে করা হয়। এদের অনেকেই আবার আরেকটি বিষয় বৃদ্ধি করেছে যে, চার মাযহাবের বাইরে অন্য কিছুর তাকলিদ করা নিষিদ্ধ। আর এটি শেষ জামানা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

হে আমার ভাই, আল্লাহ আপনাকে রহম করুক।সুতরাং বিষয়টি চিন্তা করুন। একজন মুসলমানের পক্ষে এটা বলা কীভাবে বৈধ হতে পারে যে, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত হওয়া নিষিদ্ধ?! কুরআন-সুন্নাহ থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে, আর নিষ্পাপ নয় এমন লোকদের কথা মেনে কীভাবে বৈধ হতে পারে এমন বলা যে, কুরআন-সুন্নাহ শেখা, কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক নয়? এ জাতীয় কথার কথকদের ভুলের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই।

যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়, কুরআন-সুন্নাহ শেখা দুঃসাধ্য কঠিন, তাহলে এটিও একটি মিথ্যা ধারণা। কারণ কিতাব ও সুন্নাহ শেখা সুবিস্তীর্ণ নানা মত ও ইজতিহাদের চরমতম জটিল বিষয়গুলো শেখার চেয়ে অনেক সহজ।”
·মুহাক্কিকগণের এই উক্তিগুলো এমন আরও বহু উক্তির মধ্যে অল্পই, অসংখ্যের মধ্যে সামান্যই। বিষয়টি যেন এ প্রবাদের ন্যায়—ঘাড়কে যা বেষ্টন করে তা-ই মালা হিসেবে যথেষ্ট। তাঁদের বক্তব্যগুলো ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করার খণ্ডন, কিংবা ইজতিহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন তালিবুল ইলমদের জন্য ইজতিহাদের বৈধতা ঘোষণা, অথবা ইজতিহাদের শর্ত বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করা বিষয়েই ঘোরপাক খাচ্ছে।

শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে সক্ষম, সে অবশ্যই কাউকে অনুকরণ করবে না, বরং মতবিরোধের ক্ষেত্রে হকের অধিক নিকটতম মত গ্রহণ করবে। যে ব্যক্তি সরাসরি কুরআন সুন্নাহ থেকে বিধিবিধান গ্রহণ করতে সক্ষম নয়, তার জন্য আহলুল ইলমদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া বিধেয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।’ (সুরা নাহল: ৪৩)” [দেখুন: শুওয়াইর সংকলিত ইবনু বাযের মাজমুল ফাতাওয়া গ্রন্থ (৩/৫২)]
·
এই জামানায় ইজতিহাদ করা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে, যা আল্লাহরই অনুকম্পা। আল্লামা মুহাম্মাদ আল আমিন আশ-শানকিতি রাহিমাহুল্লাহ এ বিষয়টি জোর দিয়ে বারবার বলেছেন। তিনি তদীয় আদওয়াউল বায়ান গ্রন্থে (৭/২৬৪) বলেছেন, “তোমার জেনে রাখা উচিত, এই যুগে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসুলের সুন্নাত শেখা পূর্বেকার যুগগুলোর তুলনায় অনেক সহজ। কারণ ইজতিহাদের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো জানা সহজ হয়েছে। যেমন নাসিখ, মানসুখ, আম, খাস, মুত্বলাক্ব, মুক্বায়্যিদ, মুজমাল, মুবায়্যিন, হাদিসের রাবিদের অবস্থা, সহিহ-জইফের মাঝে পার্থক্য প্রভৃতি বিষয়ক জ্ঞান। কেননা এগুলোর সবই সুরক্ষিত ও সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এগুলোর সবই আয়ত্ত করা আজকের যুগে সহজ হয়েছে।

কুরআনের প্রত্যেক আয়াতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা এসেছে, এরপর সাহাবি, তাবেয়ি এবং বড়ো মুফাসসিরগণের কাছ থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তা বিদিত হয়েছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বর্ণিত সকল হাদিস সুরক্ষিত ও লিখিত হয়েছে, হাদিসের সনদ ও মতনের অবস্থা বিদিত হয়েছে, আর হাদিসের ত্রুটিবিচ্যুতি ও দুর্বলতাও জানা হয়ে গিয়েছে। ইজতিহাদের ক্ষেত্রে যে সকল শর্ত রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে অর্জন করা প্রত্যেকের জন্যই সহজ, যাদেরকে আল্লাহ সমঝ ও জ্ঞানের দিক থেকে তা রিজিকস্বরূপ প্রদান করেছেন।

আজকের যুগে নাসিখ, মানসুখ, খাস, আম, মুত্বলাক্ব, মুকায়্যিদ প্রভৃতি সম্পর্কে জানা কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে গবেষণাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই সহজ, যাদেরকে আল্লাহ সমঝ দান করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহ জানার তৌফিক দিয়েছেন।”
আর ইজতিহাদকে আরও সহজ করেছে ইলেক্ট্রনিক লাইব্রেরি ও সার্চ ইঞ্জিনগুলো, যেসব বিষয় সময় ও কর্মপ্রচেষ্টা সংক্ষেপ করে দিয়েছে এবং এমন অনেক বিষয় জানা সহজ করে দিয়েছে, যা জানা এসব ছাড়া (এত সহজে) সম্ভব হতো না। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।
·কিছু সতর্কীকরণ:
প্রথম সতর্কীকরণ:
ফিকহের মৌলিক বইগুলোর ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। এসব বইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা ছাড়াছাড়ি করি না। আবার এসব দিয়ে ইবাদত করে আমরা ফিকহ নিয়ে বাড়াবাড়িও করি না। বরং আমরা ফিকহ বোঝার জন্য এসবের সহয়তা নিই। কারণ এটা উত্তম সহায়ক। যেহেতু ত্বলিবুল ইলমের জন্য এসব বইয়ের ওপর ব্যুৎপত্তি অর্জন না করে, এসব বইকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে ফিকহবিদ হওয়া অত্যন্ত কঠিন।

সুলাইমান ইবনে আব্দুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ তাঁর তাইসিরুল আযিযিল হামিদ গ্রন্থে (পৃ. ৪৭৩) বলেছেন, “যদি আপনি বলেন, মাযহাব বিষয়ে রচিত গ্রন্থাবলির কতটুকু একজন মানুষের জন্য পড়া বিধিসম্মত? তাহলে বলা হবে, কিতাব ও সুন্নাহ বোঝার জন্য, মাসআলা উপলব্ধি করার জন্য এসব গ্রন্থের সহয়তা নেওয়ার ভিত্তিতে এগুলো অধ্যয়ন করা বৈধ। সুতরাং এগুলো সহায়ক গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত হবে। পক্ষান্তরে ফিকহের বইগুলোকে কুরআন-সুন্নাহর ওপরে প্রাধান্য দেওয়া, মানুষের বিবাদমান বিষয়ে এগুলোকেই ফায়সালাকারী বানানো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে বিচারপ্রার্থী না হয়ে এসব কিতাবের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া প্রভৃতির মতো বিষয় সরাসরি ইমানের পরিপন্থি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব আপনার রবের কসম, তারা ইমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর আপনি যে ফায়সালা দিবেন সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে তা মেনে নেয়।’ (সুরা নিসা: ৬৫)”
·দ্বিতীয় সতর্কীকরণ:
নিশ্চয় তাকলিদের সমালোচনায় ফিকহের ইমামদের বক্তব্য অনেক। সেই সকল বক্তব্য এবং বর্ণনাগুলো সবিস্তারে সংকলন করেছেন ইবনু আব্দিল বার্র আল-মালিকি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহ’ কিতাবে এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তার ‘ইলামুল মুয়াক্কিয়িন’ কিতাবে। এগুলো সবই একজন বিদ্যার্থীকে ত্রুটিযুক্ত পর্যায় তথা তাকলিদ থেকে পূর্ণতার পর্যায়ে তথা ইজতিহাদে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রদানকৃত দাওয়াত। এটা গোঁড়া ও কথিত ফকিহদের তরিকার পরিপন্থি, যারা বিদ্যার্থীর জীবন নষ্ট করেছে তাকলিদের অন্ধকার আর মাযহাবি গোঁড়ামির মধ্যে।
·
তৃতীয় সতর্কীকরণ:
আংশিক ইজতিহাদের মর্যাদায় উপনীত হওয়া নিষিদ্ধ নয় এবং কঠিনও নয়। বরং কুরআনকে উপদেশগ্রহণের জন্য যে সহজ করা হয়েছে, এর দাবি অনুযায়ী এ কাজ সহজ। আর এটা সম্পন্ন হবে এভাবে। একজন ছাত্র প্রায়োগিক উসুলুল ফিকহ অধ্যয়ন করবে, কোনো একজন প্রাজ্ঞ কল্যাণকামী শিক্ষকের কাছে ফিকহ পড়ে প্রয়োগ শিখে নেবে। যিনি তাকে মতভেদপূর্ণ মাসআলায় ‘প্রাধান্যযোগ্য অভিমত বাছাইয়ের’ অনুশীলন করাবেন এবং তার মস্তিষ্ককে উর্বর করবেন, যাতে তার বাহু ও আঙুল শক্তিশালী হয়।

পরিশেষে বলছি, ফিকহ বিষয়ে গোঁড়ামীকারীদের কর্মপন্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হল দলিল অনুসরণ করার নামে অন্যদের নিকটি ফিকহি গোলযোগের বিদ্যমানতা। আমাদের সকলের ওপর আবশ্যক হলো দলিলের অনুসরণ করা এবং ফিকহ শেখার ক্ষেত্রে আলেমদের পথ অনুসরণ করা। কেননা আলেমগণ ফিকহ অধ্যয়ন করে ফিকহ শিখেছেন। তাঁরা গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি করেননি। বরং তাঁরা ফিকহের সহায়তা নিয়ে ফিকহ অধ্যয়ন করেছেন। সুতরাং হে আহলুল ইলম এবং ত্বলিবুল ইলম, ইজতিহাদের ভালোবাসাকে আপনারা জীবিত করুন, ইজতিহাদের জন্য চেষ্টাপ্রচেষ্টা করুন, ইসলামের যুবকদের মাঝে মাযহাবি গোঁড়ামি ও নিন্দনীয় তাকলিদ ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি বর্জন করুন। যাতে তারা মুহাক্কিক ফকিহ হতে পারে, ইলমের ক্ষেত্রে নিরীক্ষক-সূক্ষ্মদর্শী হতে পারে এবং ফিকহ ও উসুল বিষয়ে বিজ্ঞ হতে পারে। যেন তারা আল্লাহর তৌফিকে নাজাত পায় ফিকহি গোঁড়াদের জাল থেকে, যারা এখন ভিত্তি-জোরদারমূলক পড়াশোনা শেখানোর নামে জাহেল লোকজন ও ছোটো তালিবুল ইলমদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে বসেছে। আল্লাহ তায়ালাই সঠিক পথের পথপ্রদর্শক। হে আল্লাহ, আমাদেরকে এমন ইলম দিন, যেটা আমাদের উপকারে আসে এবং আমাদের দেওয়া ইলমের মাধ্যমে আপনি আমাদের উপকৃত করুন।
·উৎস: www.islamancient(ডট)com/متعصبة-المذاهب-الفقهية-،،،-والتشديد-ف/966504268668।
·ভাষান্তর: খন্দকার খালেদ
সম্পাদনা: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা


Post a Comment

0 Comments