পথ |
ভ্রষ্ট আহলে কুরআনের মুখোশউন্মোচন।
🔶রাসূল(সাঃ)উক্ত দল সম্পর্কে
ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
‘জেনে রাখো আমাকে কিতাব(কুরআন) এবং তার সাথে অনুরূপ একটি
বস্ত্ত দেয়া হয়েছে। অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন কোন পেটপুরে খাদ্য গ্রহণকারী
(প্রাচুর্যবান) ব্যক্তি তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ
কুরআনকেই গ্রহণ কর,
তাতে যা হালাল পাবে তা হালাল আর তাতে যা হারাম পাবে তা
হারাম মনে কর’ (আবুদাঊদ
হা/৪৬০৫ প্রভৃতি;তিরমিযী: ২৬৬৪, মিশকাত হা/১৬২)।
অন্য হাদীছে এসেছে, ‘আমি যেন তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন অবস্থায় না পাই যে, সে তার সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকবে এবং তার নিকট
যখন আমার আদিষ্ট কোন বিষয় অথবা আমার নিষেধ সম্বলিত কোন কিছু (হাদীছ) উত্থাপিত হবে
তখন সে বলবে,
আমি তা জানি না, আল্লাহ
তা‘আলার কিতাবে আমরা যা পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব’ 👉(আবুদাঊদ হা/৪৬০৪
প্রভৃতি;আহমাদ ৪/১৩১-৩২ মিশকাত হা/১৬৩)।
🔶রাসূল(সাঃ)- এর উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকে বাস্তবে
দেখা দেয়। এ সময় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সুন্নাতকে অস্বীকার করে। ইমাম শাফেঈ এমন একজন হাদীছ
অস্বীকারকারী ব্যক্তির সাথে তার মুনাযারার কথা উল্লেখ করেছেন 👉(কিতাবুল উম্ম ৭/২৮৭-২৯২)।
🔶যুগে যুগে হাদীস অস্বীকারীর ফিতনা থেকে সতর্ক থাকুন।🔶
🔶কেবল আল্লাহর বাণী ও তাঁর রিসালাত পৌঁছানোই দায়িত্ব। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।
👉[সূরাআল জ্বিনঃ ২৩]
🔶❝বল, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর’। তারপর যদি তারা
মুখ ফিরিয়ে নেয়,
তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না।❞ 👉[সূরা আল ইমরানঃ ৩/১৩২]
🔶❝আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও
রাসূলের,
যাতে তোমাদেরকে দয়া করা হয়।❞
👉[সূরা আত তাওবাঃ ৯/৭১]
🔶আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ 👉(সূরা আল-হাশর : ৭)
🔶আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’👉(সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
🔶আহলে কুরআন বা হাদীছ অস্বীকারকারীদের বিধান🔶
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের
সর্বসম্মত মতানুযায়ী আহলে কুরআন বা হাদীস অস্বীকারকারীরা কাফির। নিম্নে কয়েকজন
বিদ্বানের মতামত উল্লেখ করা হল :
(১)ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছ অস্বীকারকারীদের ধ্বংস অনিবার্য’। [শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল-জামা‘আতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৮।]
(২)ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাহ্ওয়াইহ(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যার কাছে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর কোন একটি ছহীহ হাদীছ পৌঁছেছে, অতঃপর সে কোন ভয়ের আশঙ্কা ছাড়াই তাকে অস্বীকার করেছে, তবে সে নিশ্চিতরূপে কাফির’।👉[ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.১৯, ফৎওয়া নং-১১৫১২৫]
(৩)শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য নয়, তারা কাফির, তাদের হত্যা করা অপরিহার্য’। 👉[আল-ওয়াসিয়্যাতুল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৫]
(৪)ইমাম সূয়ুত্বী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা নবী(ﷺ)-এর হাদীছকে অস্বীকার করে তারা কাফির এবং তারা ইসলামের গণ্ডি ও
চৌহদ্দি থেকে নিষ্কাষিত হয়ে ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান
অথবা অন্য কোন বিধর্মী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে’। 👉[মিফতাহুল জান্নাহ্ ফিল ইহতিজাজি বিস
সুন্নাহ, পৃ. ১৪]
(৫)ইমাম ইবনু দাক্বীক্ব আল-ঈদ(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছ প্রমাণিত হওয়ার পরেও যারা তা প্রত্যাখ্যান করে তারা
স্পষ্ট কাফির’। 👉 [শারহুল ইলমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৭-১৭৮]
(৬)ইমাম ইবনু হায্ম(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমরা শুধু
কুরআনের বিধানই মানব,
হাদীস মানব না, তবে সে
সর্বসম্মতিক্রমে কাফির’। 👉[আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮০]
(৭)শায়খ আবূ বাকর আল-আজুর্রী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলিমগণ বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মধ্যে যে সমস্ত বিধানকে ফরয করেছেন, তার পদ্ধতি ও নিয়ম-কানূন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ছাড়া উপলব্ধি করা অসম্ভব। আর যারা এর বিপরীত বলবে, অর্থাৎ যারা বলবে যে, সুন্নাত
ছাড়াও ইসলাম মানা সম্ভব তারা কাফির। তারা ইসলামী দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নাস্তিকদের
অন্তর্ভুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে’। 👉 [আশ-শারী‘আহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১২।]
(৮)শায়খ ইবনু বায(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা সুন্নাতকে অস্বীকার করে তারা কাফির ও স্বধর্মত্যাগী। কেননা সুন্নাতকে অস্বীকার করা কুরআনকে অস্বীকার করার নামান্তর। যে কিতাব ও সুন্নাতকে অথবা এর কোন একটিকে অস্বীকার করে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির। অবশ্যই তাকে এ সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা দরকার’।👉 [মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৭৬-১৭৮]
(৯)সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘যারা সুন্নাত অনুযায়ী আমাল করাকে অস্বীকার করে তারা কাফির’।
👉[ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৪ ও ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২০]
(১০)ইমাম সুয়ূত্বী(রহঃ) বলেন, ‘তারা কাফের এবং ইসলাম হ’তে খারিজ। তাদের হাশর হবে ইহূদী ও
নাছারা বা অন্যান্য ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের সাথে’ 👉 (মিফতাহুল জান্নাহ পৃঃ ৫)।
আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা
নিরসনের উপায়
🔶অবতরণিকাঃ
ইসলাম ধর্মের নামে নব্য আবিষ্কৃত
দলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তিকর দলটির নাম হল, ‘আহলে কুরআন’। পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত ‘উম্মুল কুরা’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শায়খ খাদিম হুসাইন ইলাহী বাখ্শ (হাফিযাহুল্লাহ) ‘উম্মুল
কুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স (M.A) করার সময় ‘আহলে কুরআন’ সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে তিনি فِرْقَةُ
أَهْلِ
الْقُرْآنِ
بِبَاكِسْتَانِ
وَمَوْقِفُ
اْلِإسْلَامِ
مِنْهَا শীর্ষক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ (Thesis) রচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর
প্রবন্ধকেই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি ‘আহলে কুরআনের উৎপত্তি’ নামক
শিরোনামে বলেছেন,
🔶‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে ১৭০০ শতকের শেষের দিক থেকেই হাদীছ
সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অন্তরে সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব
ও সংশয় তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে ইসলাম ধর্মের
নামে অত্যাধিক জঘন্য,
বিপদগামী, আদর্শচ্যুত, দিশেহারা, ধ্বংসাত্মক ও
মারাত্মক দু’টি দল উদ্ভাবিত ও অভ্যুদিত হয়েছে। যার একটির নাম ‘ক্বাদিয়ানী’, আর অপরটির নাম ‘আহলে কুরআন’। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম
অভিশপ্ত গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানী নিজেকে নাবী বলে দাবী করার মাধ্যমে ‘ক্বাদিয়ানী’
সম্প্রদায় শিরোনামে আসে। আর ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে একই প্রদেশ থেকে হাদীছ অস্বীকারকারী
‘আব্দুল্লাহ চড়কলাবীর প্ররোচনায় ‘আহলে কুরআন’ নামক অপর একটি ভ্রান্ত দলের উৎপত্তি
হয়। যে সাধারণ মানুষদের সুন্নাতকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে শুধু কুরআন মানার
প্রতি আহ্বান করতে থাকে এবং সে ‘লাহোরের জিনিয়ান-ওয়ালী’ নামক একটি মাসজিদে আশ্রয়
গ্রহণ করে। শুরুর দিকে মূলত দু’জন ব্যক্তি-ই এই ভ্রান্ত মতবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল।
একজন পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের ‘মুহিব্বুল হাক্ব আজীম আবাদী’, অপরজন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে পলায়নকারী ‘লাহোরের আব্দুল্লাহ
চড়কলাবী’। [আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২১]
🔶আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এরা দু’জনেই কিন্তু
সাইয়্যিদ আহমাদ খাঁন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ‘ছাওতু আলীকারাহ বা আলীগড়ের ডাক’
নামক আন্দোলনের সময়কালে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্বীন মানার জন্য শুধু কুরআনকেই যথেষ্ট মনে করতে হবে এবং হাদীছকে শারঈ দলীল
হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না’। এই আহ্বান ‘মুহিব্বুল হাক্ব আযীমাবাদী’ ও আব্দুল্লাহ
চড়কলাবীকে’ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল’। [প্রাগুক্ত, ১ম
খণ্ড, পৃ.
২২]
🔶বর্তমানে ‘আহলে কুরআন’ নামক দলটি চারটি উপদলে বিভক্ত।
যথা: (১) উম্মাতু মুসলিম
আহলুয-যিকর ওয়াল কুরআন (২) উম্মাতুন মুসলিমাতুন (৩) তুলূঊ ইসলাম এবং (৪) তাহরীকু
তা‘মীর ইসলাম’। [প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৬৪]
ইসলামের নামে যে সমস্ত মাযহাব, দল ও মতবাদের অভ্যুদয় ঘটেছে তাদের স্বধর্মভ্রষ্টতা, পদস্খলিতা ও অধঃপতনের বিষয়টি পরিস্ফুটিত করার সর্বাধিক
সহজবোধ্য ও সহজলব্ধ উপায় হল তার উৎপত্তিকাল সম্পর্কে পরিজ্ঞাত বা তথ্যাভিজ্ঞ হওয়া।
কেননা হাদীছে,
আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর(রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,
لَيَأْتِيَنَّ
عَلَى أُمَّتِيْ
مَا أَتَى
عَلَى بَنِيْ
إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ
النَّعْلِ بِالنَّعْلِ
حَتَّى إِنْ
كَانَ مِنْهُمْ
مَنْ أَتَى
أُمَّهُ عَلَانِيَةً
لَكَانَ فِيْ
أُمَّتِيْ مَنْ
يَصْنَعُ ذَلِكَ
وَإِنَّ بَنِيْ
إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ
عَلَى ثِنْتَيْنِ
وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً
وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ
عَلَى ثَلَاثٍ
وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً
كُلُّهُمْ فِي
النَّارِ إِلَّا
مِلَّةً وَاحِدَةً
قَالُوْا وَمَنْ
هِيَ يَا
رَسُوْلَ اللهِ؟
قَالَ مَا
أَنَا عَلَيْهِ
وَأَصْحَابِيْ.
🔶‘বানী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে
আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া
জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের
সাথে ব্যভিচার করে থাকে,
তবে আমার উম্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বানী ইসরাঈল ৭২
দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সব
দলগুলোই জাহান্নামী হবে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর
রাসূল (ﷺ)! সে দল কোন্টি? তিনি বললেন, আমি ও আমার
ছাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত’। [তিরমিযী, হা/২৬৪১; মিশকাত, তাহক্বীক্ব ছানী, হা/১৬৯, ১৭১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ,
হা/১৩৪৮; ছহীহুল জামি‘, হা/৫৩৪৩]
🔶উপরিউক্ত হাদীছের আলোকে একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতীয়মান হয় যে, যারাই রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এবং তাঁর ছাহাবীগণের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে, বিবিধ দলসমূহের মধ্য হতে শুধু তারাই প্রকৃত ইসলামের ও
হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর তারাই সফলতা, সার্থকতা এবং
পরিত্রাণ পাবে।
🔶আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে আহলে কুরআনদের অবস্থান:
প্রকৃতপক্ষে এদের ‘আহলে কুরআন’
না বলে ‘মুনকিরুল হাদীছ বা হাদীছ অস্বীকারকারী’ বলা উচিত। কেননা কুরআন
মান্যকারীদের উপর হাদীছ মানা অপরিহার্য। বস্তুত আল-কুরআনের মধ্যেই হাদীছের প্রামাণিকতা
বিদ্যমান। হাদীছের সত্যতা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেউ ‘আহলে কুরআন’ হতে পারে
না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
فَلَا وَ رَبِّکَ لَا
یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ
فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا
یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ
حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا
‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে
পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ
না করে,
অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না
থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)। তিনি আরো বলেন,
وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ
الۡعِقَابِ
🔶‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর
এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক।
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (সূরা আল-হাশর : ৭)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡہَوٰی -
اِنۡ ہُوَ اِلَّا
وَحۡیٌ یُّوۡحٰی
‘আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা
তো অহী,
যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ
مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الۡہُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّہٖ مَا
تَوَلّٰی وَ نُصۡلِہٖ جَہَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا
🔶‘আর কারো নিকট সৎপথ প্রকাশিত হওয়ার পরও যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে তাকে আমি সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে সে ফিরে যেতে চায় এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কতই না মন্দ আবাস!’ (সূরা আন-নিসা : ১১৫)।তিনি আরো
قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ
فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ
اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
🔶‘(হে নবী!) আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩১)।
🔶সুধী পাঠক! হাদীছের প্রামাণিকতায় এ রকম আরো সহস্র আয়াত বিদ্যমান। অতএব বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আহলে কুরআন’ নামক দলটি কুরআন-সুন্নাহ্ ও শরী‘আতের দলীলাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নাম আহলে কুরআন হলেও কিন্তু আসলে তারা কুরআনের কিছুই বুঝে না। আর বুঝবেই বা কী করে! হাদীছ ছাড়া কি কুরআন বুঝা সম্ভব? এদের ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক পূর্বেই সতর্ক করে বলেছেন, ‘জেনে রাখ! আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে অনুরূপ কিছু দেয়া হয়েছে। জেনে রাখ! এমন এক সময় আসবে যখন কোন প্রাচুর্যবান ব্যক্তি তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ কুরআনকেই আঁকড়ে ধর, তাতে যা হালাল পাবে তাকে হালাল হিসাবে এবং যা হারাম পাবে তাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। নবী (ﷺ) বলেন, জেনে রাখ! গৃহপালিত গাধা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং ছেদন দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র পশুও নয়’। [আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৭৪, ১৭১৯৪, সনদ হাসান।]
🔶উপরিউক্ত মতামতের পক্ষের দলীল বর্ণনায় নিম্নে দু’টি হাদীছ উল্লেখ করা হল: রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি ঔদাসীন্য ও বিরাগ পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়’। [ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৫৩৪]
🔶অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ أَطَاعَنِيْ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَى اللهَ ‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা‘আলারই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে আল্লাহ তা‘আলারই নাফরমানী করল’।[ছহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭, ৭১৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৫]
🔶আল-কুরআনুল কারীমকে আমরা যেমন আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করি, অনুরূপভাবে হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের আক্বীদা কেমন হতে হবে?
🔶এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআনের মত হাদীছও অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, হাদীছকে কুরআনের মত তেলাওয়াত করা হয় না’। [মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৩]
🔶খাত্বীব আল-বাগদাদী(রাহিমাহুল্লাহ), হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর আদেশে যেভাবে জিবরীল(আলাইহিস সালাম) নবী (ﷺ)-এর নিকট কুরআন নিয়ে অবতরণ করতেন, ঠিক একই রকম ভাবে তাঁর উপর সুন্নাত নিয়েও অবতরণ করতেন’।[আল-কিফায়াহ, পৃ. ১২; ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ২৯১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৭৭২৪৩]
🔶দলীলগুলো নিম্নরূপ:🔶
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
🔶২. আনাস ইবনু মালিক(রাযিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযূ করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির
নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا
أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’। [আবূ দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩০]
🔶৩. রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, أَلَا
إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রাখ!
আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে সমকক্ষ বা সমতুল্য কিছু দেয়া হয়েছে’। [আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৭৪, ১৭১৯৪, সনদ হাসান ]
🔶ইমাম শাফিঈ(রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য মুহাদ্দিছ বলেন, ‘সমতুল্য জিনিস’ বলতে হাদীছকেই বুঝানো হয়েছে। [মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৪]
🔶৪. আবূ মাসঊদ আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিবরীল (আলাইহিস
সালাম) অবতরণ করে ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন। রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ‘আমি এভাবে ছালাত শিখাতে আদিষ্ট হয়েছি’। [ছহীহ বুখারী, হা/৫২১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১০]
উক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জিবরীল(আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে সুন্নাত শিখানোর জন্যই অবতরণ করেছিলেন। অতএব বুঝা গেল যে, সুন্নাত বা হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।
🔶৫. আবূ হুরায়রা(রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,مَا أُوْتِيْكُمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا أَمْنَعُكُمُوْهُ إِنْ أَنَا إِلَّا خَازِنٌ أَضَعُ حَيْثُ أُمِرْتُ ‘আমি আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস দিই না এবং আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বঞ্চিতও করি না। আমি তো কেবল কোষাধ্যক্ষ বা বণ্টনকারী। আমাকে যেখানে ব্যয়ের নির্দেশ দেয়া হয় সেখানেই ব্যয় করি’। [আবূ দাঊদ, হা/২৯৪৯, সনদ ছহীহ]
উক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মুতাবিক রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কোনরূপ কমবেশি ছাড়াই বণ্টন করতেন। অতএব প্রমাণিত হল যে, হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। [আল-মাদখাল ইলাস-সুন্নাতিল নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৬১]
🔶৬. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَنۡزَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکَ
الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ
فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا
‘আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও
হিকমাত অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না, তা আপনাকে
শিক্ষা দিয়েছেন। আর আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১১৩)। অন্যত্র
তিনি বলেছেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی
الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا
عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ
ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ
ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৬৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি কুরআনুল কারীমের অগণিত বিশেষজ্ঞের নিকটে শুনেছি, তাঁরা বলেছেন, ‘এখানে ‘কিতাব’ বলতে কুরআনুল কারীমকে বুঝানো হয়েছে আর ‘হিকমাত’ বলতে রাসূল(ﷺ)-এর সুন্নাতকে বুঝানো হয়েছে’।🔶[আহকামুল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮; আর-রিসালাহ, পৃ. ৪৫; তাফসীরে ত্বাবারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৫৭-৫৫৮]
🔶 (শেষ কিস্তি)🔶
আহলে কুরআন বা হাদীছ
অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন
আহলে কুরআন বা হাদীছ বিরোধীদের
বিভ্রান্তিকর হাতিয়ারের নাম হল, অনৈতিক যুক্তি। তারা
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ মানুষকে আদর্শচ্যুত করার জন্য তাদের সামনে কিছু
উদ্ভট প্রশ্ন ও নীতিহীন যুক্তি পেশ করে থাকে। নিম্নে তাদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার মোক্ষম জবাব
উপস্থাপন করা হল :
🔶প্রথম সংশয়🔶
তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কিতাব-ই যথেষ্ট। কেননা কুরআনের
মধ্যেই সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনকে বুঝার জন্য অথবা শরী‘আতের
কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুন্নাত বা হাদীছের প্রয়োজন নেই। [মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৪৯, ৩য় সংখ্যা, ১৯০২ খ্রি. ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৮৬, ১৯০২ খ্রি.; বুরহানুল ফুরক্বান, পৃ. ৪]
🔶নিরসন:🔶
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনে মূলত শরী‘আতের মূল নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে এবং
কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা বা বিধি-বিধানের নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরণ ও
প্রকৃতি সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি। যদি তাই হয় তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের
রাক‘আত সংখ্যা,
উট,
গরু,
ছাগল, স্বর্ণ ও রৌপ্যের
যাকাতের নিসাব বা পরিমাণ,
ছিয়ামের বিধি-বিধান, হজ্জের
নিয়ম-কানুন ইত্যাদি কোথায় বলা হয়েছে? যদি রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত না থাকত, তাহলে আমরা
এগুলো কোথায় থেকে জানতে পারতাম। সেই জন্যই ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম
আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত-ই হল, আল্লাহ
তা‘আলার কিতাবের ব্যাখ্যাকারী’। [রিসালাতুশ
শাফিঈ, ১ম খ-, পৃ. ৭৯; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৩১১১]
আল্লামা বাদরুদ্দীন আল-যারকাশী
(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় রিসালাতের ‘রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য’ নামক অনুচ্ছেদে বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنۡ
یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের
আনুগত্য করল,
সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)। এমন প্রত্যেকটি বিষয়
যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে ফরয করেছেন যেমন : ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি। যদি রাসূল (ﷺ) এগুলোর নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত না করতেন, তাহলে আমরা সেগুলো কিভাবে আদায় বা পালন করতাম? তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত আমাদের পক্ষে কোন ইবাদতই করা
সম্ভবপর হত না’। [আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৭-৮]
🔶‘ইসলাম ওয়েব’-এর আলিমগণ বলেন, ‘অসংখ্য আয়াত প্রমাণ
করে যে,
রাসূল(ﷺ) ছিলেন কুরআনুল
কারীমের উত্তম ব্যাখ্যাকারী। যেমন, আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ لِتُبَیِّنَ
لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیۡہِمۡ
وَ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ
‘আর আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা
চিন্তা-গবেষণা করে’ (সূরা আন-নাহল :
৪৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ اِلَّا
لِتُبَیِّنَ لَہُمُ الَّذِی اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ ۙ وَ ہُدًی وَّ
رَحۡمَۃً لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
🔶‘আমি তো আপনার প্রতি কিতাব এ জন্যই অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তাদেরকে আপনি তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন এবং
বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া স্বরূপ’। (সূরা
আন-নাহল : ৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর
এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক।
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (সূরা আল-হাশর : ৭)।
আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা
বলেছেন,
‘আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও’ (সূরা
আল-মায়িদাহ : ৩৮)।
এখানে সাধারণভাবে চুরি করলেই
চোরের হাত কাটার কথা বলা হয়েছে। জাহিরিয়্যাহ্ মাযহাবের ফকীহবিদদের মতানুযায়ী চুরির
এই বিধান সকল প্রকার চুরির জন্য ব্যাপক, চুরির পরিমাণ
অল্প হোক অথবা বেশি,
সুরক্ষিত জায়গা থেকে চুরি করা হোক অথবা অরক্ষিত জায়গা থেকে, সর্বাবস্থাতেই চোরের হাত কাটা যাবে। অথচ বাণীসূচক হাদীছের
মধ্যে রাসূল(ﷺ) বলেছেন, ‘এক চতুর্থাংশ স্বর্ণমুদ্রা (দীনার) বা ততোধিক চুরি করলে
তবেই হাত কাটা যাবে’।
[ছহীহ
বুখারী, হা/৬৭৮৯, ৬৭৯০, ৬৭৯১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৮৪, নাসাঈ, হা/৪৯৪৩]
🔶অতঃপর রাসূল(ﷺ)-এর কর্মসূচক
হাদীছ এবং ছাহাবীদের আমল ও স্বীকারোক্তি থেকে তা আরো পরিস্ফুটিত হয়। এরকম শতসহ¯্র আয়াত আছে, যার বিশুদ্ধ
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত
ছাড়া সম্ভব নয়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে
কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হল :
(১)আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুল্ম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)।
ছাহাবীগণ এই আয়াতের ‘যুলম’ শব্দ
দ্বারা সাধারণ ছোট-বড় অত্যাচার করা বুঝেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হলে ছাহাবীগণ চমকে
উঠেন এবং ভীতিকর অবস্থায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ হে আল্লাহর রাসূল(ﷺ)! আমাদের মধ্যে
এমন কে আছে,
যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুল্ম করেনি? এ আয়াতে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে
যুল্মকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কী?
রাসূল(ﷺ) উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত
অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে যুল্ম বলতে শিরকক বুঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنَّ
الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘নিশ্চিত শিরক বিরাট যুলম’।
[সূরা
লুক্বমান : ১৩; ছহীহ
বুখারী, হা/৩২, ৩৩৬০, ৩৪২৮, ৩৪২৯, ৪৬২৯, ৪৭৭৬, ৬৯১৮, ৬৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৪; তিরমিযী, হা/৩০৬৭]
কাজেই
আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে, অতঃপর
আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর ইবাদাতে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে না, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত।
(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি
তোমাদের আশংকা হয় যে,
কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে ছালাত ক্বছর (সংক্ষিপ্ত) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই।
নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা আন-নিসা : ১০১)।
🔶উপরিউক্ত আয়াত থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বছরের ছালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে জন্যই কিছু
ছাহাবায়ে কিরাম রাসূল (ﷺ)-কে বিস্মৃত
হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস
করলাম,
আল্লাহ তা‘আলা যে বলেছেন, ‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদের উপর
আক্রমণ করবে,
তবে ছালাত ক্বছর (সংক্ষিপ্ত) করলে এতে তোমাদের কোন দোষ
নেই’। আর মানুষ তো এখন নিরাপদে আছে? (অর্থাৎ তাহলে কি নিরাপদ স্থানে ক্বছর করা যাবে না?) জবাবে তিনি বলেন, তুমি যে
বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ,
আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম। তাই আমিও এ বিষয়ে
রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস
করেছিলাম,
তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওটা তো একটি ছাদাক্বাহ্ বিশেষ, যা আল্লাহ
তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর ছাদাক্বাহ্ গ্রহণ কর’।
[ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬; তিরমিযী, হা/৩০৩৪; নাসাঈ, হা/১৪৩৩; আবূ দাউদ, হা/১১৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫, ২৪৬]
(৩)আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৩)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছের বিধান কী হবে? কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কী-না?!
রাসূল(ﷺ)-এর বাণীসূচক হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সমস্ত প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া
হালাল,
আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল(ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা
হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হল,
মাছ ও টিড্ডি, এবং
দু’প্রকারের রক্ত হল,
কলিজা ও প্লীহা’।
[ইবনু
মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; ছহীহুল জামি‘, হা/২১০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১১১৮]
এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ কোন দ্বিমত
পোষণ করে না,
এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও
নবী (ﷺ)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা ভক্ষণ করছে।
🔶(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতি যে অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আহারকারী যা আহার করে, তার মধ্যে আমি কিছুই নিষিদ্ধ পাই না। তবে মৃতপ্রাণী, বহমান রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত, কেননা তা অপবিত্র। অথবা যব্হকালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম
নেয়ার কারণে যা অবৈধ’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪৫)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুকুরের বিধান কী হবে? সাপের বিধান কী হবে? ইঁদুরের বিধান কী হবে? শকুনের বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কি-না?!
🔶রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতের
সুবিধার্থে উক্ত আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করেন। তিনি একটি উছূল বা মূলনীতি
বর্ণনা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) খায়বার
যুদ্ধের দিন শিকারী দাঁতযুক্ত যে কোন হিং¯্র জন্তু এবং নখযুক্ত যে কোন শিকারী পাখী আহার করতে নিষেধ
করেছেন।
[ছহীহ বুখারী, হা/৫৫২৭, ৫৫৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৩২-১৯৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩২৩৪; নাসাঈ, হা/৪৩৪৮; আবূ দাঊদ, হা/৩৮০৩, ৩৮০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/ ২১৯৩, ২৭৪২, ৩০১৫, ৩০৬০, ৩১৩১, ৩৫৩৪; ইরওয়াউল গালীল, হা/২৪৮৮।]
🔶দ্বিতীয় সংশয়:🔶
তারা মনে করে যে, হাদীছ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী নয়, বরং এগুলো তো কথা মাত্র যা আল্লাহর নামে মিথ্যা চালানো
হচ্ছে (নাউযুবিল্লাহ)। [আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৮১; ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৯১; মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৩৫; চতুর্থ সংখ্যা, ১৯০৩ খ্রি.]
নিরসন:
আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ) এবং সুন্নাতের স্থান স্পষ্ট করে বলেন,
وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا
بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ- لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ
بِالۡیَمِیۡنِ- ثُمَّ لَقَطَعۡنَا
مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ - فَمَا مِنۡکُمۡ مِّنۡ اَحَدٍ عَنۡہُ حٰجِزِیۡنَ
🔶‘যদি তিনি আমার নামে কিছু রচনা করে চালানোর চেষ্টা করতেন। তবে অবশ্যই আমি তাঁকে
ডান হাত দ্বারা পাকড়াও করতাম এবং তাঁর জীবন-ধমনী কেটে দিতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে
এমন কেউ নেই যে তাঁকে রক্ষা করতে পারত’ (সূরা আল-হাক্কাহ : ৪৪-৪৭)।
উক্ত আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, যদি রাসূল (ﷺ) নিজের পক্ষ থেকে কিছু বানিয়ে বলার চেষ্টা করতেন অথবা এতে কম-বেশি
করতেন,
তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পাকড়াও করতেন এবং তাঁকে
ঢিল দিতেন না। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য রাসূল ছিলেন। যেহেতু তাঁকে আল্লাহ শাস্তি প্রদান করেননি তার
মানে এই যে,
তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বানিয়ে বলেননি।
🔶পক্ষান্তরে হাদীছের প্রামাণিকতায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
🔶উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের মত
সুন্নাতও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। [তাফসীরে কুরতুবী, ৭ম খ-, পৃ. ২৬৫৫]
সাইয়িদ রশীদ রেযা
(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘হাদীছে বর্ণিত বিধানগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।
অহী শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়’। [তাফসীরুল মানার, ৮ম খ-, পৃ. ৩০৮]
🔶দলীল হল আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীছ। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ওযূ করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির
নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا
أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’। [আবূ দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খ-, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩০]
🔶🔶উপরিউক্ত বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে হাদীছের মধ্যে, অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রতিপালক এমনই করতে বলেছেন। তার মানে বুঝা
যাচ্ছে হাদীছও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। তবে হ্যাঁ, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন,
🔶ক. আল-কুরআন অহী
মাতলু আর হাদীছ অহীয়ে গায়রে মাতলু।
🔶খ. আল-কুরআন
মু‘জিযাসমূহের মধ্যে একটি,
কিন্তু হাদীছ তা নয়।
🔶গ. আল-কুরআনের শব্দ
ও অর্থ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে
নাযিলকৃত। পক্ষান্তরে হাদীছের অর্থ আল্লাহর কিন্তু শব্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর।
🔶ঘ. আল-কুরআন ইসলামী শরী‘আতের
প্রথম উৎস,
আর ছহীহ হাদীছ ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস।
🔶ঙ. আল-কুরআন ছালাতের
মধ্যে তেলাওয়াত করা হয়,
কিন্তু হাদীছ ছালাতে তেলাওয়াত করা হয় না।
🔶চ. আল-কুরআন
তেলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ-দশ ছাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু হাদীছ পাঠে কোন নির্ধারিত ছাওয়াব পাওয়া যায় না।
🔶ছ. আল-কুরআন
তেলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা একটি প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু হাদীছ
পাঠের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। [ক্বাওয়াঈদুত
তাহদীছ, পৃ.
৬৪; উছূলুল
হাদীছ, পৃ.
২৯; ইসলাম
ওয়েব, ফৎওয়া
নং-৬৮৮০৫, ৭২৭৯৮; আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২১৫-২১৭]
🔶তৃতীয় সংশয়::
এই নির্বোধেরা বলে থাকে যে, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানা
যাবে না,
কেননা এটি শিরক। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنِ
الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰہِ ‘হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই’। (সূরা
আল-আন‘আম : ৫৭)। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা যাবে না। [আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৪২]
🔶নিরসন: 🔶
🔶এ কথা ঠিক যে আদেশ কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মানতে হবে। কিন্তু সেই আল্লাহ তা‘আলাই
তো রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানার
নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
فَلَا وَ رَبِّکَ لَا
یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ
فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا
فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا
‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের
শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের
বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং
সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়’ (সূরা
আন-নিসা : ৬৫)।
🔶উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তার শপথ করে বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মেনে
না নেয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না।
🔶অতএব প্রমাণিত হয় যে,
রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর আদেশ মানাটাই হল আল্লাহর আদেশ মানা। [আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২২০] অন্যত্র তিনি বলেন,
‘যখন মুমিনদেরকে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ
এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা তো
কেবল এ কথাই বলে,
আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ওরাই হল সফলকাম’। (সূরা আন-নূর : ৫১)।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান মানা যাবে না’ রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে এই বিধানের গণ্ডির বাইরে রাখা হয়েছে। বরং এটি রাসূল(ﷺ) ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنۡ
یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের
আনুগত্য করল,
সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)।
🔶উপসংহার🔶
🔶উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে ইসলামী আইন প্রণয়নে এবং কুরআনের সঠিক
ব্যাখ্যা বুঝার ক্ষেত্রে সুন্নাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সূর্যালোকের ন্যায়
পরিস্ফুটিত হয়। যদি আমরা উপরিউক্ত উদাহরণগুলো এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্তকরণের
উদ্দেশ্যে যেগুলোকে আমরা এখানে উল্লেখ করিনি সেগুলোকেও একটু গভীরভাবে বিবেচনা করি, তাহলেই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাব যে, সুন্নাতের সাহায্য ছাড়া কুরআনুল কারীমকে পূর্নাঙ্গরূপে
বুঝার এবং তার উপর আমল করার কোন উপায় নেয় । [মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৪-১২]
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে
সালাফে ছালিহীনের মানহাজ অনুযায়ী কুরআনুল কারীমকে বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দান
করুন। আমীন!!
-হাসিবুর রহমান
বুখারী** মুর্শিদাবাদ, ভারত।
editor by
rasikul, time: 06:30pm, date: 25/01/2023
0 Comments