প্রশ্ন:কোন ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী দেয়া বৈধ? পশু কুরবানী করার সঠিক
পদ্ধতি কি? মাংস কিভাবে বন্টন করতে হবে।গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
➤ভূমিকা আরবী যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা।
এটা মুসলিম সমাজে কুরবানীর ঈদ নামেও পরিচিত।
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা
বিভিন্ন নামে পরিচিত। ভারত ও পাকিস্তানে এটাকে ‘বকরী ঈদ’ বলা হয়ে থাকে।
আরবী ‘কুরবান’ (قربان) শব্দটি
ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে,যার অর্থ ‘নৈকট্য।পারিভাষিক অর্থে:আল্লাহর
নৈকট্য লাভের আশায় উৎসর্গকৃত পশু কিংবা অন্য যে কোনো কিছুকে আরবীতে ‘কুরবান’ বলা হয়।
সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে
‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে।
ইসলামের অন্যতম ইবাদত হলো এ কুরবানী।
পূর্ববর্তী নবীগণের উপরও এ বিধান চালু ছিল। আল্লাহ বলেন,আমি প্রত্যেক জাতির উপর কুরবানীর
বিধান রেখেছিলাম’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৪)।
কুরবানীর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়,
মানব ইতিহাসে প্রথম কুরবানী অনুষ্ঠিত হয়েছিল আদম আঃ-এর পুত্র হাবীল ও কাবীলের মাধ্যমে।
হাবীলের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠার কারণে তার কুরবানী আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছিল।
অপরদিকে কাবীলের অনাগ্রহ ও নিষ্ঠাহীনতার
কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল (সূরা আল-মায়েদা, ৫/২৭)।
কুরবানী আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি
অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এতে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাত আদায়ের সাথে সাথে
প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতও পালন করা হয়।
কেননা তিনি নিজে কুরবানী করেছেন এবং
তাঁর উম্মতের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে অবশিষ্ট রেখে গেছেন।
ফলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কুরবানীর বিধান
বলবৎ থাকবে ইনশাআল্লাহ। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক।
তাই এর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ
জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একান্ত দায়িত্ব।
◾➤কুরবানীর
উদ্দেশ্য :
কুরবানী করা একটি মহান ইবাদাত।কুরবানীর
মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা।
কুরবানী হতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর
উদ্দেশ্যে।
কে কত বড় পশু কুরবানী দিল, কার কুরবানী
দেখতে কত সুন্দর, কতটা মোটাতাজা, এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দেখেন না।
বরং তিনি দেখেন মানুষের অন্তর ও তাক্বওয়া।মহান
আল্লাহ বলেন, এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে
তোমাদের তাক্বওয়া’ (সূরা হজ্জ, ৩৭)।
আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসূল(ﷺ) বলেছেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক গঠন
ও বিত্ত-বৈভবের দিকে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল’।(সহীহ মুসলিম,
হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪)
◾➤কুরবানীর
পশু :
কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের
হয় যে শ্রেণী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। আর নির্ধারিত শ্রেণীর পশু চারটি; উঁট, গরু,
ভেঁড়া ও ছাগল।
অধিকাংশ উলামাদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট
কুরবানী হল উঁট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেঁড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা
উত্তম।
যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে।(আযওয়াউল
বায়ান ৫/৬৩৪) এগুলোর বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না।
তবে অনেক বিদ্বান মহিষকে গরুর অন্তর্ভুক্ত
করেছেন এবং তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয বলেছেন।[সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪-৪৫; মির‘আতুল
মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৮১)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘উপরে বর্ণিত
পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না’।(কিতাবুল উম্ম খন্ড:২ পৃষ্ঠা:২২৩)
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া
প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে
জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: কুরবানীর ক্ষেত্রে কোন পশু উত্তম: কাবশ (পূর্ণবয়স্ক ভেড়া); নাকি গরু?
জবাবে তারা বলেন: সর্বোত্তম কুরবানীর
পশু হলো উট। তারপর গরু। তারপর شاة (ভেড়া বা ছাগল)। তারপর উট
বা গরুতে অংশীদারিত্ব।
যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম জুমার নামাযের ব্যাপারে বলেছেন: “যে ব্যক্তি প্রথম ঘণ্টায় (মসজিদে) গেল সে
যেন একটি উট কুরবানী করল...।”
হাদিস থেকে প্রমাণ পদ্ধতি: আল্লাহ্র
নৈকট্য হাছিলের ক্ষেত্রে উট, গরু ও গানাম (ভেড়া-ছাগল)-এর মাঝে ব্যবধান থাকা। কোন সন্দেহ
নাই যে, কুরবানী আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এবং যেহেতু উটের দাম বেশি,
গোশত বেশি ও উপকারিতাও বেশি।
তাই তিনজন ইমাম: আবু হানিফা, শাফেয়ি
ও আহমাদ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।ইমাম মালেক বলেন: উত্তম হলো ভেড়া, এরপর গরু, এরপর উট।
কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটো কাবশ (পূর্ণবয়স্ক ভেড়া) দিয়ে কুরবানী
করেছেন। যেটা উত্তম তিনি সেটা ছাড়া অন্যটি করেন না।
এই দলিলের জবাবে বলা যায়: নিশ্চয়
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি কোমলতাস্বরূপ কখনও কখনও অনুত্তমটি
নির্বাচন করেন। যেহেতু উম্মত তাঁকে অনুসরণ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উম্মতের প্রতি কঠোরতা আরোপ করতে চান না।
আর তিনি তো গরু ও গানাম (ভেড়া-ছাগল)-এর
উপর উটের মর্যাদা বলেই দিয়েছেন; যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।(ফাতাওয়া
লাজনাহ দায়িমাহ;খন্ড:১১ পৃষ্ঠা:৩৯৮)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম আলেম ইমাম উসাইমীন
(রাহিমাহুল্লাহ) তার আহকামুল উযহিয়্যাহ’ গ্রন্থে বলেন:
“কুরবানীর পশুর মধ্যে উত্তম হলো:
উট, তারপর গরু যদি কেউ গোটা উট বা গোটা গরু দিয়ে কুরবানী করে। তারপর ভেড়া।
তারপর ছাগল। তারপর উটের সাতভাগের
একভাগ।তারপর গরুর সাতভাগের একভাগ।(ইসলামি সাওয়াল জবাব ফাতাওয়া নং-৪৫৭৫৭)
◾➤কুরবানীর পশুর বয়সঃ
যেকোনো রঙের পশু দ্বারা কুরবানী করা
বৈধ,তবে কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম।
আর পশুর বয়সের ক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত
বয়সে পৌঁছা যেমন: ভেড়া হলে ‘জাযআ’ হওয়া (অর্থাৎ ছয়মাস পূর্ণ হওয়া)।
আর অন্য শ্রেণীর হলে ‘ছানিয়্যা’ হওয়া
(অর্থাৎ এক বছর পূর্ণ হওয়া)। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
“তোমরা মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হওয়া ছাড়া কোন প্রাণী জবাই করবে না।
তবে তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেলে ছয়
মাস বয়সী ভেড়া জবাই করতে পার”।[সহিহ মুসলিম হা/১৯৬৩) মুসিন্না (পূর্ণ বয়স্ক) হচ্ছে-
‘ছানিয়্যা’ ও ‘ছানিয়্যা’ এর চেয়ে বেশি বয়স্ক পশু। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- ‘ছানিয়্যা’ চেয়ে
কম বয়স্ক পশু।
উটের ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ হচ্ছে-
যে উটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে।
গরুর ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’ হচ্ছে-
যে গরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।
ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে ‘ছানিয়্যা’
হচ্ছে- যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আর ‘জাযআ’ হচ্ছে- যে পশুর ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে।
সুতরাং উট, গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে
‘ছানিয়্যা’ এর চেয়ে কম বয়সী পশু দিয়ে কোরবানী শুদ্ধ হবে না।
আর ভেড়ার ক্ষেত্রে ‘জাযআ’ এর চেয়ে
কম বয়সী পশু দিয়ে কোরবানী হবে না।( ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৭৫৫) উলামাগণ এ
বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা
না যাক।(সহীহ বুখারী ২১৭৮,সহীহ মুসলিম হা/১৯৬৫)
◾➤যেসকল পশু দ্বারা কুরবানী করা নাজায়েজ:
কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত
হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যেমন- কোরবানীর পশু ঐ সব দোষ-ত্রুটি
মুক্ত হওয়া যেগুলোর কারণে কোরবানী আদায় হয় না; এমন ত্রুটি ৪টি:
(১)। চোখে স্পষ্ট ত্রুটি থাকা: যেমন
চোখ একেবারে কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া কিংবা বোতামের মত বের হয়ে থাকা কিংবা এমন সাদা
হয়ে যাওয়া যে, সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, চোখে সমস্যা আছে।(২)।
সুস্পষ্ট
রুগ্নতা: যে রোগের প্রতিক্রিয়া পশুর উপরে ফুটে উঠে। যেমন, এমন জ্বর হওয়া
যার ফলে পশু চরতে বের হয় না ও খাবারে তৃপ্তি পায় না। এমন চর্মরোগ যা পশুর গোশত নষ্ট
করে দেয় কিংবা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
(৩)। স্পষ্ট খোঁড়া হওয়া: যার ফলে
পশুর স্বাভাবিক হাঁটা-চলা ব্যাহত হয়।
(৪)।এমন জীর্ণ-শীর্ণতা; যা অস্থির
মজ্জা নিঃশেষ করে দেয়।
এ সংক্রান্ত দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরবানীর ক্ষেত্রে কোন ধরণের পশু পরিহার করতে হবে এ সম্পর্কে
জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলেন: “চারটি: পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট,
চোখে সমস্যাযুক্ত; যে সমস্যা স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, এবং দুর্বল; যার
অস্থি-মজ্জা নেই”(মুসনাদ আহমাদ হা/১৮৬৯৭, ১০৪৮, ১০৬১; তিরমিযী হা/১৪৯৭; ইবনু মাজাহ
হা/৩১৪৪ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২)
২/৩০ পৃ.)
সুনান গ্রন্থসমূহের অপর একটি রেওয়ায়েতে
এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে
বললেন: “কোরবানীর ক্ষেত্রে চার ধরণের পশু জায়েয হবে না” এরপর তিনি অনুরূপ হাদিস উল্লেখ
করেন।(আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ হা/১১৪৮ ) উপরোক্ত এ চারটি ত্রুটি থাকলে সে পশু দিয়ে
কোরবানী দেয়া জায়েয হবে না।
এ ত্রুটিগুলোর সমপর্যায়ের কিংবা এগুলোর
চেয়ে মারাত্মক অন্য ত্রুটিসমূহকেও এ ত্রুটিগুলোর অধিভুক্ত করা হবে। সে রকম কিছু ত্রুটি
নিম্নরূপ:
(১)। অন্ধ পশু; যে তার দুই চোখে কিছুই
দেখে না।
(২)। যে পশু তার সাধ্যের অতিরিক্ত
খাবার খেয়েছে; যতক্ষণ না তার তরল পায়খানা হয়ে সে আশংকামুক্ত হয়।
(৩)। যে পশু গর্ভবতী; কিন্তু পশুটি
শংকার মধ্যে রয়েছে; যতক্ষণ না তার শংকা দূরীভূত হয়।(৪)। গলায় ফাঁস লেগে কিংবা উপর থেকে
পড়ে যে পশু আহত হয়ে মৃত্যুপথ-যাত্রী যতক্ষণ না সে পশু শংকামুক্ত হয়।
(৫)। যে পশু কোন রোগজনিত কারণে হাঁটতে
অক্ষম।
(৬)। সামনের এক পা কিংবা পিছনের এক
পা কর্তিত পশু। এ ত্রুটিগুলো যদি পূর্বে হাদিসে উল্লেখিত ত্রুটিগুলোর সাথে একত্রিত
করা হয় তাহলে সর্বমোট ১০ টি ত্রুটি হবে; যেগুলোর কারণে কোন পশুকে কোরবানী করা জায়েয
হবে না।
উল্লেখিত ৬ টি এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত
৪ টি।(শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন এর ‘আহকামুল উযহিয়্যাহ ও যাকাত’ শীর্ষক পুস্তিকা
থেকে ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-
৩৬৭৫৫) উল্লেখ্য যে, খাসি করা কোন
খুঁৎ নয়। বরং এতে পাঁঠা ছাগলের দুর্গন্ধ দূর হয় এবং গোশত রুচিকর হয়।
রাসূল (ﷺ) নিজে দু’টি
মোটাতাজা খাসি দিয়ে কুরবানী করেছেন।[ইবনু মাজাহ হা/৩১২২; ইরওয়া হা/১১৩৮, ৪/৩৫১ পৃষ্ঠা;
মিশকাত হা/১৪৬১)
◾➤কুরবানী করার পদ্ধতি :
উট অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ত
করা সম্ভব নয়), তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে।
আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘সুতরাং দন্ডায়মান
অবস্থায় ওদের যবেহকালে তোমরা আল্লাহর নাম নাও।’’(সূরা হজ্জ:ন ২২/৩৬) মোটকথা উট দাঁড়ানো
অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’
বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা
দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘জবাই’ করতে হয়।
যেহেতু তা সহজ এবং ডান হাতে ছুরি
নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। তবে যদি যবেহকারী নেটা বা বেঁয়ো
হয় তাহলে সে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করতে পারে। যেহেতু সহজ উপায়ে যবেহ করা ও পশুকে
আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্য।
পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে
যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা
মুচড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।(সুবুলুস সালাম,খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:১৭৭
মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ পৃ.)
কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী
হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে তাড়াতাড়ি পশু জবাই করবে যেন পশুর কষ্ট কম হয়।
এ সময় রাসূল (ﷺ) নিজের
ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবেহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন।
যদি যবেহকারী ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে যান, তাহ’লেও কোন দোষ বর্তাবে না ইনশাআল্লাহ।
কেননা কেবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা
ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই।(শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ২/২২৩ পৃষ্ঠা আহকামুল
উযহিয়্যাহ ৮৮,৯৫ পৃষ্ঠা) রাসূল (ﷺ) নিজ হাতে কুরবানী যবেহ করেছেন।
অন্যের দ্বারা যবেহ করানো জায়েয আছে।
তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম।
হাকেম ও বায়হাক্বীর একটি যঈফ সূত্র অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ মর্মে
কন্যা ফাতেমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।(মির‘আত ২/৩৫০ পৃ. ; ঐ, ৫/৭৪ পৃ.)
◾➤কুরবানীর পশু যবেহকালীন দো‘আ:
যে ব্যক্তি কোরবানীর পশু জবাই করতে
চান তার জন্য নিম্নোক্ত দোয়া পড়া সুন্নত:
بسم الله ، والله أكبر ، اللهم هذا منك ولك ، هذا عني اللهم تقبل من فلان وآل فلان
(বিসমিল্লাহ্। ওয়াল্লাহু আকবার।
আল্লাহুম্মা হাযা মিনকা, ওয়া লাকা। হাযা আন্নি। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন ... ওয়া
আলি ...)[ডট দেয়া স্থানদ্বয়ে কোরবানীকারীর নাম উল্লেখ করবে] (অর্থ- আল্লাহ্র নামে
শুরু করছি।
আল্লাহ্ই মহান। হে আল্লাহ্, এটি
আপনার পক্ষ থেকে; আপনারই জন্য। এটি আমার পক্ষ থেকে উৎসর্গিত (আর অপরের পক্ষ থেকে হলে
বলবে: অমুকের পক্ষ থেকে)।
হে আল্লাহ্, অমুকের ও তার পরিবারের
পক্ষ থেকে কবুল করুন) এই দোয়ার মধ্যে শুধু ‘বিসমিল্লাহ্’বলা ওয়াজিব। বিসমিল্লাহ্
এর অতিরিক্ত যে কথাগুলো আছে সেগুলো বলা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্নিত যে, তিনি
বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকালো ডোরাকাটা লম্বা শিংওয়ালা দুইটি
দুম্বা দিয়ে কোরবানী দিয়েছেন। তিনি দুম্বার ঘাড়ের পার্শ্বদেশের উপর পা রেখে ‘বিসমিল্লাহ’
ও ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিজ হাতে জবাই করেছেন।(সহীহ বুখারী হা/৫৫৬৫ মুসলিম হা/১৯৬৬)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি লম্বা শিংওয়ালা দুম্বা আনার নির্দেশ
দিলেন।
কোরবানী করার জন্য দুম্বাটি আনা হল।
তখন তিনি আয়েশাকে বললেন: আয়েশা, ছুরিটি নিয়ে আস। এরপর বললেন: পাথর দিয়ে ছুরিটি ধার
দাও।
আয়েশা ধার দিলেন। এরপর তিনি ছুরিটি
নিলেন এবং দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন। এরপর ‘বিস্মিল্লাহ্; আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন
মুহাম্মদ, ওয়া আলে মুহাম্মদ, ওয়া মিন উম্মাতি মুহাম্মদ’ বলে পশুটিকে জবাই্ করা শুরু
করলেন এবং কোরবানী দিলেন”।(সহিহ মুসলিমে হা/১৯৬৭)
জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে
বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে
ঈদগাহে উপস্থিত হলাম। তিনি খোতবা শেষ করে মিম্বর থেকে নেমে আসলেন। এরপর দুম্বা আনা
হল।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে পশুটিকে জবাই্ করলেন। তিনি বললেন: বিসমিল্লাহ্, ওয়া আল্লাহু
আকবার, হাযা আন্নি ওয়া আম্মান লাম ইউযাহ্হি মিন উম্মাতি’ (অর্থ- আল্লাহ্র নামে শুরু
করছি। আল্লাহ্ই মহান। এটি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে যারা কোরবানী করতে
পারেনি তাদের পক্ষ থেকে)।(আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত
করেছেন](তিরমিযি হা; ১৫২১)কোন কোন রেওয়ায়েতে ‘আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা ওয়া লাকা’
(হে আল্লাহ্, এটি আপনার পক্ষ থেকে এবং আপনারই জন্য) অতিরিক্ত এসেছে।
[দেখুন: ইরওয়াউল গালিল হা/১১৩৮ ও
১১৫২) ইমাম উসাইমীন বলেন,“আল্লাহুম্মা মিনকা” (অর্থ- হে আল্লাহ্, এটি আপনার পক্ষ থেকে):
এ কথার অর্থ হচ্ছে এ কোরবানীর পশুটি আপনারই দান।
এ রিযিক আপনার পক্ষ থেকে আমার কাছে
পৌঁছেছে।“ওয়া লাক” (অর্থ- আপনার জন্য): এ কথার অর্থ হচ্ছে- এটি একনিষ্ঠভাবে আপনারই
জন্য।[দেখুন: উসাইমিন ‘আল-শারহুল মুমতি’ ৭/৪৯২) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে,
তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।
(ইবনু কুদামা, আল-মুগনী (বৈরূত ছাপাঃ
তারিখ বিহীন) ১১/১১৭ পৃ.) জেনে রাখা ভাল যে,পশু যবেহর পর পঠনীয় কোন দুআ নেই।
.▪️পশুকে কষ্ট না দিয়ে জবাই করা
:
কুরবানীসহ যে কোনো পশু জবাই করার
সময় লক্ষ রাখতে হবে, পশু যেন কষ্ট না পায় এবং সহজেই সে প্রাণত্যাগ করতে পারে।
এর জন্য জবাইয়ের ছুরিকে উত্তমরূপে
ধার দিয়ে নিতে হবে পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে হবে।শাদ্দাদ ইবনে আওস(রা.)
বলেন, রাসূল (সা.)বলেছেন,‘আল্লাহ সবকিছুর উপর দয়া করা অপরিহার্য করে দিয়েছেন।
সুতরাং যখন হত্যা করবে, তখন উত্তমভাবে
হত্যা করো। যখন (পশু-প্রাণী) জবাই করবে, তখন উত্তমভাবে জবাই করো। আর প্রত্যেকে যেন
ছুরিতে ধার দিয়ে নেয় এবং জবাইয়ের পশুকে শান্তি দেয়’।(সহীহ মুসলিম, হা/১৯৫৫; মিশকাত,
হা/৪০৭৩)
◾➤আরো কিছু বিষয় লক্ষনীয়ঃ
➤(১). যবেহতে খুন বহা জরুরী। আর তা দুই শাহরগ (কন্ঠনালীর
দুই পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, ‘‘যা খুন বহায়, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর।
তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাঁত
বা নখ না হয়।’(আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ) সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার
জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরী; শক্ষাসনালী, খাদ্যনালী এবং পাশর্ক্ষস্থ দুই মোটা শিরা।
➤(২). প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে
কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার
আগে বৈধ নয়।
অনুরূপভাবে দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া
ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা কাল
পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যেহেতু অন্যভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
➤(৩).পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না।
বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।
➤(৪).যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয়
তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার
ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
➤(৫).যবেহ করে ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে)
কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবেহ করা যায়। নতুবা কিছু পরেই সে এমনিতেই
মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে, আর তা হালাল।
➤(৬).প্রকাশ থাকে যে, যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা যবেহকারীকে
পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস
ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরী। সুতরাং কাফের, মুশরিক (মাযার বা কবরপূজারী) ও বেনামাযীর হাতে
যবেহ শুদ্ধ নয়।
➤(৭).পাশাপাশি যবেহ করার আগে কুরবানীর পশুকে গোসল দেওয়া,
তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়ায করা বিদআত।
উল্লেখ্য যে, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম।
অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি
করে খেলা করা বৈধ নয়।( বই কুরবানীর বিধান আব্দুল হামিদ ফাইজি মাদানি)
.◾➤কুরবানীর গোশত বন্টন
ও সংরক্ষণ:
কুরবানীর গোশত তিন শ্রেণীর মানুষ
খাবে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুঃস্থ অভাবীকে আহার
করাও”।[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ২৮] আল্লাহ্ আরও বলেন: “তখন তোমরা তা থেকে খাও এবং আহার
করাও এমন দরিদ্রকে যে ভিক্ষা করে এবং এমন দরিদ্রকে যে ভিক্ষা করে না।
এভাবে আমরা সেগুলোকে তোমাদের বশীভূত
করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”।[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৩৬]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহ আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন
ও একভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ সায়েলদের তথা ভিক্ষুকদের মধ্যে ছাদাক্বাহ
করতেন’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি সনদ বিহীন।[ আলবানী, ইরওয়াউল গালীল, হা/১১৬০; মির‘আত,
হা/১৪৯৩, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১২০ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৪৪; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ১১তম খণ্ড,
পৃ. ১০৮-০৯)
সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত
আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা খাও, খাওয়াও এবং সংরক্ষণ
করে রাখ”।[সহিহ বুখারী] হাদিসে ‘খাওয়াও’ কথাটি ধনীদেরকে হাদিয়া দেয়া এবং দরিদ্রদেরকে
দান করাকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা খাও, সংরক্ষণ করে রাখ এবং দান কর”।[সহিহ
মুসলিম হা/২৮০৪)
কোরবানির গোশত কতটুকু খাওয়া যাবে,
কতটুকু হাদিয়া দেওয়া হবে এবং কতটুকু সদকা করা হবে এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন।
তবে এ ক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে।
অগ্রগণ্য অভিমত হচ্ছে- এক তৃতীয়াংশ খাওয়া, এক তৃতীয়াংশ হাদিয়া দেওয়া এবং এক তৃতীয়াংশ
সদকা করা। যে অংশটুকু খাওয়া জায়েয সে অংশটুকু সংরক্ষণ করে রাখাও জায়েয; এমন কি সেটা
দীর্ঘ দিন পর্যন্ত হলেও যতদিন পর্যন্ত রাখলে এটি খাওয়া ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছবে না।
কিন্তু যদি দুর্ভিক্ষের বছর হয় তাহলে
তিনদিনের বেশি সংরক্ষণ করা জায়েয নয়। দলিল হচ্ছে সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) এর হাদিস তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের যে মধ্যে ব্যক্তি
কোরবানি করেছে তৃতীয় রাত্রির পরের ভোর বেলায় তার ঘরে যেন এর কোন অংশ অবশিষ্ট না থাকে”।
পরের বছর সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস
করল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমরা কি গত বছরের মত করব? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বললেন: “তোমরা খাও, খাওয়াও এবং সংরক্ষণ কর। ঐ বছর মানুষ কষ্টে ছিল।
তাই আমি চেয়েছি তোমরা তাদেরকে সহযোগিতা
কর”।[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম] ওয়াজিব কোরবানি হোক কিংবা নফল কোরবানি হোক; গোশত খাওয়া
কিংবা হাদিয়া দেয়ার হুকুমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
অনুরূপভাবে কোন জীবিত ব্যক্তির পক্ষ
থেকে কোরবানি করা হোক কিংবা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা হোক কিংবা কোন ওসিয়তের
প্রেক্ষিতে কোরবানি করা হোক এ বিধানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
কেননা ওসিয়ত-পূর্ণকারী ব্যক্তি ওসিয়তকারীর
স্থলাভিষিক্ত হন। ওসিয়তকারী খেতে পারেন, হাদিয়া দিতে পারেন এবং সদকা করতে পারেন।
কেননা এটাই তো মানুষের মাঝে প্রথাগতভাবে
প্রচলিত। আর যেটা প্রথাগতভাবে প্রচলিত সেটা শব্দ দিয়ে উচ্চারণ করার সমতুল্য।
জেনে রাখা ভাল য কোরবানির পশুর গোশত, চামড়া ইত্যাদি
কোন কিছুই বিক্রি করা হারাম। কসাইকে তার পারিশ্রমিক কিংবা পারিশ্রমিকের অংশ বিশেষ কোরবানির
পশুর গোশত থেকে দেওয়া যাবে না।
কেননা এটা বেচা-বিক্রির অধিভুক্ত।আর
যাকে কোরবানির পশুর হাদিয়া দেওয়া হল কিংবা সদকা দেওয়া হল তিনি এ গোশত বিক্রি করা কিংবা
অন্য যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। তবে, তাকে যিনি হাদিয়া দিয়েছেন কিংবা সদকা দিয়েছেন তার
কাছে বিক্রি করতে পারবেন না।(ইসলামি সাওয়াল জবাব ফাতাওয়া নং-৩৬৫৩২)
◾➤একনজরে পশু কুরবানী করা সংক্রান্ত
কয়েকটি মাসয়ালা:
➤(১) ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময়
কুরবানী করা যাবে।(মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৪৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃ. নায়লুল
আওত্বার ৬/২৫৩)তবে অনেক সাহাবী, ইমাম শাফেঈ ও বহু বিদ্বানের মতে ঈদুল আযহার পরের তিনদিন
কুরবানী করা যাবে।
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী এটাকেই অগ্রাধিকার
দিয়েছেন।(ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাদাবীহ ৫/১০৬-০৯
পৃ.)
➤(২).দিনে রাতে যে কোন সময় কুরবানী করা জায়েজ। অনেকে
সন্ধ্যার পরে কুরবানী করা নাজায়েয মনে করেন। এটা ঠিক নয়।বরং রাতেও কুরবানী করা যায়
তবে উত্তম হল দিনে করা।
➤(৩).কুরবানীর পশু যবেহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর
গোশত বা চামড়ার পয়সা হ’তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না।
সাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী
দিতেন।(মুসলিম হা/১৩১৭; বুখারী হা/১৭১৭; মিশকাত হা/২৬৩৮)অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে
হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।(বুঃ মুঃ মিশকাত হা/২৬৩৮; মির‘আত হা/২৬৬২-এর
আলোচনা, ৯/২৩০ পৃ.)
➤(৪) কুরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ। তবে তার চামড়া
বিক্রি করা জায়েজ। চামড়া বিক্রি করে শরী‘আত নির্দেশিত সাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে
(সূরা তওবা ৬০)। এগুলি মহল্লায় বায়তুল মাল ফান্ডে জমা করে আল্লাহভীরু বিশ্বস্ত মুতাওয়াল্লীর
মাধ্যমে সুশৃংখল ভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার সাথে ব্যয় করা উত্তম।
আজকাল বড় বড় শহরে পেশাদার ভিক্ষুক
ও তাদের সহযোগীদের দেখা যায় অনেক পরিমাণ কুরবানীর গোশত সংগ্রহ করে তা পরে কম দামে অন্যের
কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের দুষ্কর্ম থেকে এখুনি তওবা করা উচিত।
মনে রাখা ভাল যে, আল্লাহর ন্যায় বিচারে
ধনী-গরীব কেউ ছাড় পাবে না। (বিস্তারিত মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আহমাদ, নায়ল ৬/২৫৫-৫৬; মির‘আত
৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃ.
➤(৫) কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করা নাজায়েয।
আল্লাহর রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য
সাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।(মাজমূ‘
ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৩০৪; মুগনী, ১১/৯৪-৯৫ পৃ.)
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী সাদাক্বার
চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের সালাত অন্য সকল নফল সালাতের চাইতে উত্তম।(তাফসীরে কুরতুবী
(সূরা ছাফফাত ৩৭/১০২), ১৫/১০৮ পৃ. ।মির‘আত, ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬।
➤(৬)কুরবানীর মাংস অমুসলিম দরিদ্র প্রতিবেশীকেও দেওয়া
যায় (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮)।ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৪২৪)। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত
নফল সাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত (আল-মুগনী ৩/৫৮৩, ৯/৪৫০)।
➤(৭).কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়,
তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে।এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত
হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়।(বাইহাকী ৯/২৮৮,
আল-মুমতে ৭/৫১০) পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরবানীর সকল মাসআলা-মাসায়েল বিশুদ্ধভাবে
জানা ও সে অনুযায়ী পালন করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
❛❛জিলহজ্জ ও কুরবানী❞ ধারাবাহিক ২১ পর্বের আজ ১৭ তম পর্ব। পূর্বের পর্বগুলো
কমেন্টে দেখুন।
আপনাদের দ্বীনি ভাই,জুয়েল মাহমুদ
সালাফি
0 Comments