প্রশ্ন: কুরবানীর পশু ক্রয়ের পর ত্রুটি দেখা দিলে
বা মারা গেলে করণীয় কি? খাসিকৃত প্রাণী এবং গর্ভবতী পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে কি
?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কুরবানীর
পশু ক্রয়ের পর ত্রুটি দেখা দিলে বা মারা গেলে করণীয় কি এখানে তিনটি বিষয় লক্ষনীয়।
যেমন;
(১)কেউ যদি কোন একটি পশুকে
কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করেন, এরপর কোন অবহেলা না করা সত্ত্বেও সে পশুটি মারা যায়
সেক্ষেত্রে কুরবানীদাতার উপর কোন কিছু বর্তাবে না।
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত
ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী
(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.]বলেছেন;
“যদি কোন অবহেলা ব্যতিরেকে
তার হাত থেকে কোরবানির পশুটি ধ্বংস হয়ে যায়, কিংবা চুরি হয়ে যায়, কিংবা হারিয়ে যায়,
সেক্ষেত্রে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না।
কেননা পশুটি তার হাতে আমানত।
যদি তার অবহেলা না থাকে
সেক্ষেত্রে গচ্ছিত-রাখা সম্পদের মত তাকে এটার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না।” (ইবনু কুদামাহ,
আল-মুগনী, খন্ড: ৯, পৃষ্ঠা:৩৫৩হ আরও দেখুন: মিরদাওয়ি এর ‘আল-ইনসাফ’, ৪/৭১)
(২)। যদি সে ব্যক্তি নিজে
পশুকে ধ্বংস করে থাকে কিংবা অন্য কেউ ধ্বংস করে থাকে তাহলে যে ব্যক্তি ধ্বংসের কারণ
সে এর মূল্য কিংবা সমমানের পশু ক্ষতিপূরণ দিবে।
ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ
বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন; যদি
কেউ কোন ওয়াজিব কোরবানির পশু ধ্বংস করে তাহলে তাকে মূল্য জরিমানা দিতে হবে।
কেননা পশু এমন শ্রেণীর যেটার
মূল্য-অনুমানযোগ্য। যেদিন পশুটিকে ধ্বংস করেছে সেই দিনের মূল্য ধর্তব্য হবে।” (ইবনু
কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা:৩৫২)
(৩)কুরবানীর পশু হারিয়ে
বা চুরি হয়ে গেলে, যদি তা কুরবানী দাতার অবহেলার ফলে না হয়, তাহলে তার পক্ষে অন্য কুরবানী
জরুরী নয়।
কারণ, তা তার হাতে এক প্রকার
আমানত, যা যত্ন সত্ত্বেও বিনষ্ট হলে তার যামানত নেই।
তবে ভবিষ্যতে ঐ পশু যদি
ফিরে পায়, তবে কুরবানীর সময় পার হয়ে গেলেও ঐ সময়েই তা যবেহ করবে।
কিন্তু যদি কুরবানী দাতার
অবহেলা ও অযত্নের কারণে রক্ষা না করার ফলে হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে
অন্য একটি পশু কুরবানী করা জরুরী হবে। (বিস্তারিত জানতে মিরদাওয়ি এর ‘আল-ইনসাফ’, ৪/৭১)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ
আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন; “কোন মানুষ যদি সুদৃঢ়
সংকল্পের সাথে তার সাধ্যে যা কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে তা করে তাহলে শরিয়তের দৃষ্টিতে
সে ব্যক্তি পরিপূর্ণ কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তির সমান।
পরিপূর্ণ কার্য সম্পাদনকারীর
সওয়াব কিংবা শাস্তি সে ব্যক্তি পাবে; এমনকি যা তার সাধ্যের বাইরে এর জন্যেও সে ব্যক্তি
সওয়াব কিংবা শাস্তি পাবে।
উদাহরণস্বরূপ নেক কাজে পরস্পর
পরস্পরকে সহযোগিতাকারী ব্যক্তিবর্গ।” (মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড:১০, পৃষ্ঠা:৭২২-৭২৩, আরও
জানতে দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া ২৩/২৩৬)
🔹খাসিকৃত প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা যাবে কি ?
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে
খাসিকৃত পশু কুরবানী দিতে কোন আপত্তি নেই। নিঃসন্দেহে এটি জায়েয।
হাদিসে এসেছে, আম্মাজান
আয়েশা (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
কুরবানীর ইচ্ছা করলে দু’টি মোটাতাজা, মাংসল, শিংযুক্ত, ধুসর বর্ণের খাসিকৃত মেষ ক্রয়
করতেন।
অতঃপর এর একটি নিজ উম্মাতের
যারা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁর নবুয়াতের সাক্ষ্য দেয় তাদের পক্ষ থেকে এবং
অপরটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে কোরবানী
করতেন। (মুসনাদে আহমাদ হা/২৫৩১৫, ২৫৩৫৮, ইবনু মাজাহ, হা: ৩১২২, আলবানী ইরওয়া হা/১১৩৮;
সনদ সহিহ)।
উক্ত হাদীসে উল্লিখিত ‘মাওজুআইনি’
শব্দটির অর্থ করতে গিয়ে ইমাম খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ৩৮৮ হি.) বলেছেন, والوجاء
الخصاء يقال
وجأت الدابة
فهي موجوءة
إذا خصيتها
“মাওজুআইনি শব্দের শব্দমূল বিজা মানে খাসি করা। বলা হয়, আমি প্রাণীকে বিজা করেছি, এর
মানে খাসি করেছি।” (খাত্তাবি কৃত মাআলিমুস সুনান, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২২৮)।
খাত্তাবির পরে হাদিসের আরও
অনেক ব্যাখ্যাকার বিদ্বান উক্ত অর্থ উল্লেখ করেছেন।
মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতিল
কুওয়াইতিয়্যা গ্রন্থে বলা হয়েছে, হানাফি ফাকিহগণ ব্যক্ত করেছেন, চতুষ্পদ জন্তু খাসি
করায় কোনো সমস্যা নেই।
কেননা এতে মানুষ ও চতুষ্পদ
জন্তুর কল্যাণ রয়েছে। মালিকি বিদ্বানদের মতে, আহারযোগ্য প্রাণীকে খাসি করা কোনো অপছন্দনীয়তা
ছাড়াই বৈধ; যেহেতু এতে গোশত ভালো হয়।
শাফিয়ী বিদ্বানগণ আহারযোগ্য
ও অন্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, যে প্রাণীর
গোশত খাওয়া হয়, তাকে ছোটো বয়সে খাসি করা জায়েজ; আর অন্য প্রাণীকে খাসি করা হারাম।
তবে তারা শর্তারোপ করেছেন,
খাসি করতে যেয়ে প্রাণীর বিনাশ ঘটা চলবে না। পক্ষান্তরে হাম্বালি বিদ্বানগণের নিকটে
ছাগল খাসি করা জায়েজ, যেহেতু এতে গোশত ভালো হয়।
বলা হয়, তাঁদের মতে ছাগলকে
খাসি করা ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর মতোই মাকরুহ তথা অপছন্দনীয়।” (দেখুন: মাওসুয়াতুল
ফিকহিয়্যাতিল কুওয়াইতিয়্যা, খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ১২২ অনুবাদ আব্দুল্লাহ মৃধা ভাই)
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের
সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ,
আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১
হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, পশু-প্রাণীকে খাসি করার বিধান হচ্ছে, এটা জায়েয যদি এটি উপকারী
ও ভালো হয়।
তবে খাসি করার প্রক্রিয়াটি
সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পশুকে শাস্তি না দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে
হবে। (ইবনু উসাইমিনের লিকাউল বাবিল মাফতুহ, খণ্ড: ৩৭; পৃষ্ঠা: ১৭)
🔹গর্ভবতী পশু দিয়ে কুরবানী করা কি জায়েয?
___________________________________________.
প্রথমত: স্বাভাবিক ভাবে গর্ভবতী নয় এমন পশু দ্বারা
কুরবানী দেওয়া উত্তম। তবে গর্ভবতী বাহিমাতুল আনআম (উট, গরু ও বকরী) দিয়ে কুরবানী করা
জায়েয হবে কিনা এ ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
অধিকাংশ মাযহাবের আলেমদের
মতে, এমন পশু দিয়ে কুরবানী করা জায়েয।
কুরবানীর পশুর যে ত্রুটিগুলোর
কারণে এর দ্বারা কুরবানী করা যায় না সেগুলোর মধ্যে তারা গর্ভধারণকে উল্লেখ করেননি।
তবে শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণ
ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, গর্ভবতী পশু দিয়ে কুরবানী করা নিষেধ।
মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতিল
কুওয়াইতিয়্যা গ্রন্থে বলা হয়েছে, “অধিকাংশ ফিকাহবিদ আলেম গর্ভধারণকে কুরবানীর পশুর
ত্রুটির মধ্যে উল্লেখ করেননি; তবে শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণ ব্যতীত।
তারা পরিস্কারভাবে জায়েয
না হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা গর্ভধারণের ফলে পেট নষ্ট হয়ে যায় এবং গোশত ভাল হয়
না।” (আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা’ (১৬/২৮১)
এটাই (মাযহাবের) প্রতিষ্ঠিত
অভিমত।কেননা গর্ভধারণের ফলে গোশত কমে যায়। আর যাকাতের ক্ষেত্রে গর্ভবতী পশুকে পূর্ণ
উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয় যেহেতু যাকাতের ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধির বিষয়টি উদ্দেশ্য; গোশত
ভাল হওয়া নয়।” [পরিমার্জিতরূপে সমাপ্ত]।
তবে অগ্রগণ্য অভিমত হলো:
কুরবানীর পশু হিসেবে গর্ভবতী বাহিমাতুল আনআম (উট, গরু ও বকরী) উপযুক্ত; যদি তার ক্ষেত্রে
অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে।
শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, গর্ভবতী বকরী দিয়ে কুরবানী করা সঠিক; যেমনিভাবে অ-গর্ভবতী বকরী দিয়েও সঠিক; যদি পশুটি কুরবানীর ক্ষেত্রে দোষণীয় দোষগুলো থেকে মুক্ত হয়।” (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিস শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম,৬/১৪৬)
দ্বিতীয়ত: যদি গর্ভস্থিত পশুটি জীবিত
অবস্থায় বের হয় তাহলে সেটাকে জবাই করা হবে এবং খাওয়া যাবে।
ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন- “যদি স্থিতিশীল
জীবন নিয়ে জীবিত অবস্থায় বের হয় এবং জবাই করার সুযোগ পায়; কিন্তু জবাই না করে এক পর্যায়ে
মারা যায়; তাহলে সে পশুটি জবাইকৃত হিসেবে গণ্য হবে না।
ইমাম আহমাদ বলেন: যদি জীবিত অবস্থায় বের
হয় তাহলে অবশ্যই জবাই করতে হবে। কেননা সেটি অন্য একটি প্রাণ। (আল-মুগনী গ্রন্থে; ৯/৩২১)
আর যদি মৃত অবস্থায় বের
হয় তাহলে জমহুর আলেমের মতে, সেটিও খাওয়া যাবে। কেননা মাকে জবাই করার মাধ্যমে সেটাকেও
জবাই করা হয়েছে।
আবু সাঈদ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “মায়ের জবাই গর্ভস্থিত পশুর জবাই।”(সুনানে
আবু দাউদ হা/২৮২৮, সুনানে তিরমিযি হা/১৪৭৬, মুসনাদে আহমাদ হা/১০৯৫০, ‘সহিহুল জামে’
হা/ ৩৪৩১ সনদ সহীহ)
আর যদি জীবিত অবস্থায় বের
হয় তাহলে জবাই করতে হবে।(মাজমুউল ফাতাওয়া; ২৬/৩০৭, আরো বিস্তারিত জানতে- ইসলামি সওয়াল-জবাব
ফাতাওয়া নং-১৯২০৪১)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
❛❛জিলহজ্জ ও কুরবানী❞ ধারাবাহিক ২১ পর্বের আজ ১৫ তম পর্ব। পূর্বের
পর্বগুলো কমেন্টে দেখুন।
______________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই, জুয়েল মাহমুদ সালাফি
0 Comments