❒ সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য - পর্ব-০৩

❒ সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য - পর্ব-০৩
সহীহ আকিদা RIGP  

■ ৩ নং বৈশিষ্ট্যঃ জামা’আতবদ্ধ থাকা

সালাফে সালিহীনের মানহাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বাবস্থায় ঐক্যবদ্ধ থাকা ও মুসলিম জামা’আতকে আঁকড়ে ধরা। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে আঁকড়ে ধরো। এবং তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। (সূরা আলে ইমরান; আয়াত নং ১০৩)

এই আয়াতে উল্লিখিত হাবলুল্লাহ বলতে ইবনু মাস’ঊদ (রা.)-এর মতে “জামা’আত”-কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে তাবারী) ইবনু উমার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ضَلَالَةٍ وَيَدُ اللَّهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ
“আল্লাহ্‌ তা’আলা আমার উম্মাতকে অথবা তিনি বলেছেন মুহাম্মাদ (স.)-এর উম্মতকে কখনো ভ্রষ্টতার উপরে ঐক্যবদ্ধ করবেন না। আর আল্লাহর সাহায্য জামা’আত-এর উপরে”। (সুনান তিরমিযীঃ হাদীস নং- ২১৬৭)

আব্দুল্লাহ ইবন মাস’ঊদ (রা.) একদিন মানুষদের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন,
وَأَنَّ مَا تَكْرَهُونَ فِي الْجَمَاعَةِ خَيْرٌ مِمَّا تُحِبُّونَ فِي الْفُرْقَةِ“ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় তোমরা যা অপছন্দ করো তা, তোমরা বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় যা পছন্দ করো তার থেকে উত্তম”। (ইবনু আবী শাইবাহঃ হাদীস নং- ৩৭৩৩৭)

✍ ইমাম তহাভী (রহ.) বলেন,
ونرى الجماعة حقا وصوابا والفرقة زيغا وعذابا
“আমরা জামা’আতবদ্ধ থাকাকে সত্য ও সঠিক মনে করি এবং বিচ্ছিন্ন থাকাকে ভ্রষ্টতা ও শাস্তি মনে করি”। (মাতানুত তহাভিয়্যাহ, খণ্ড. ০১, পৃ. ৮৫)

✍ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন,

ثم إن الاعتصام بالجماعة والائتلاف من أصول الدين
“অতঃপর নিশ্চয় জামা’আতকে আঁকড়ে ধরা ও ঐক্যবদ্ধ থাকা দ্বীনের মৌলিক নীতিমালার অন্যতম নীতি”। (মাজমূ’উল ফাতাওয়া, খণ্ড. ২২, পৃ. ৪৪৫)
.
সালাফগণ এবং যারা সালাফদের পথে চলতেন তারা সর্বদা জামা’আত ও হককে কেন্দ্র করে জোটবদ্ধ থাকতেন। তারা তাদের শাসকদের কথা শুনে ও মেনে চলতেন। তবে তারা শরীয়ত প্রবর্তকের (আল্লাহর) মৌলিক উদ্দেশ্য (মাকাসিদুশ শরী’আহ) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সার্বিক কল্যাণের বাস্তবায়ন ও পূর্ণতা প্রদানের জন্য এবং অকল্যাণ প্রতিরোধ ও হ্রাসকরণের জন্য নিরপরাধ ব্যক্তির রক্তের সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং রক্তকে হালাল ঘোষণা না করার সাথে সাথে বিকল্প পথও তারা গ্রহণ করেছেন। মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়ে অসংখ্য আয়াতের মধ্যে অন্যতম হলো,

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
“এবং তোমরা আল্লাহর অনুসরণ করো এবং তার রাসূলের অনুসরণ করো। তোমরা একে অপরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি চলে যাবে”। (সূরা আনফালঃ আয়াত নং- ৪৬)
.
ন্যায়সঙ্গত সকল কাজে সুখে-দুঃখে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত রাষ্ট্রের শাসকগণের কথা শোনা ও মানা জরুরি। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।” (সূরা নিসাঃ আয়াত নং- ৫৯)
.
উবাদা ইবনুস সামিত (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা তার নিকট বায়আত হলাম। তিনি তখন আমাদেরকে যে (বিষয়গুলোতে) শপথ (বায়আত) গ্রহণ করান তার মধ্যে ছিল-

أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ « إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ ».
আমাদের অনুরাগে ও বিরাগে, আমাদের সংকটে ও সাচ্ছন্দে আমরা তার কথা শুনবো ও মানবো, এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রধান্য দিলেও আমরা তা মেনে নেবো। আরও (বাই‘আত করলাম) যে আমরা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঝাগড়া করব না। কিন্তু যদি ক্ষমতাশীনদের মাঝে স্পষ্ট কুফরী দেখ আর সে বিষয়ে তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহলে আলাদা কথা। (সহীহ মুসলিমঃ হাদীস নং- ৩৪২৩)
.
শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে ঈমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)- এর খুব কাছের বন্ধু আবু-হারিস আহমাদ বিন মুহাম্মাদ এর একটা বর্ণনা পাওয়া যায়। বর্ণনাটি হলো-

‎أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي هَارُونَ، وَمُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، أَنَّ أَبَا الْحَارِثِ حَدَّثَهُمْ قَالَ: سَأَلْتُ أَبَا عَبْدِ اللَّهِ فِي أَمْرٍ كَانَ حَدَثَ بِبَغْدَادَ، وَهَمَّ قَوْمٌ بِالْخُرُوجِ، فَقُلْتُ: " يَا أَبَا عَبْدِ اللَّهِ، مَا تَقُولُ فِي الْخُرُوجِ مَعَ هَؤُلَاءِ الْقَوْمِ، فَأَنْكَرَ ذَلِكَ عَلَيْهِمْ، وَجَعَلَ يَقُولُ: سُبْحَانَ اللَّهِ، الدِّمَاءَ، الدِّمَاءَ، لَا أَرَى ذَلِكَ، وَلَا آمُرُ بِهِ، الصَّبْرُ عَلَى مَا نَحْنُ فِيهِ خَيْرٌ مِنَ الْفِتْنَةِ يُسْفَكُ فِيهَا الدِّمَاءُ، وَيُسْتَبَاحُ فِيهَا الْأَمْوَالُ، وَيُنْتَهَكُ فِيهَا الْمَحَارِمُ، أَمَا عَلِمْتَ مَا كَانَ النَّاسُ فِيهِ، يَعْنِي أَيَّامَ الْفِتْنَةِ، قُلْتُ: وَالنَّاسُ الْيَوْمَ، أَلَيْسَ هُمْ فِي فِتْنَةٍ [ص: ١٣٣] يَا أَبَا عَبْدِ اللَّهِ؟ قَالَ: وَإِنْ كَانَ، فَإِنَّمَا هِيَ فِتْنَةٌ خَاصَّةٌ، فَإِذَا وَقَعَ السَّيْفُ عَمَّتِ الْفِتْنَةُ، وَانْقَطَعَتِ السُّبُلُ، الصَّبْرَ عَلَى هَذَا، وَيَسْلَمُ لَكَ دِينُكَ خَيْرٌ لَكَ، وَرَأَيْتُهُ يُنْكِرُ الْخُرُوجَ عَلَى الْأَئِمَّةِ، وَقَالَ: الدِّمَاءَ، لَا أَرَى ذَلِكَ، وَلَا آمُرُ بِهِ "‎
"আমি আবু আবদুল্লাহ (ঈমাম আহমদ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাগদাদের একটা ঘটনার ব্যাপারে। যে ঘটনার জের ধরে কিছু সংখ্যক লোক শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি বললাম, "হে আবু আব্দুল্লাহ! শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি এর নিন্দা প্রকাশ করলেন আর বলতে আরম্ভ করলেন "সুবহানাল্লাহ! রক্তপাত (জনগণের), রক্তপাত (জনগণের)! আমি এটায় বিশ্বাস করি না আর আমি কাউকে এটা করতেও বলি না। আমাদের জন্য ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে মোকাবিলা করাটাই অধিক উত্তম ফিতনা ফ্যাসাদের মাধ্যমে রক্তপাত, সম্পদ লুন্ঠন, নারী-সম্ভ্রম বিলীন হয়ে যাওয়ার চেয়ে। তোমার কি মনে নেই, এর আগের বারের ফিতনার কারণে কি অবস্থা জনগণের হয়েছিলো?"

আমি বললাম, হে আবু আব্দুল্লাহ! আজকের জনগণ কী শাসকের ফিতনার মধ্যে দিনাতিপাত করছে না? উত্তর সে বলল, "যদি জনগণ শাসকের ফিতনায় পড়ে থাকে তাহলে তা তুলনামূলকভাবে সামান্যই কিন্তু যদি শাসকের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করা হয় তাহলে ফিতনা ঢালাওভাবে ছড়িয়ে যাবে এবং সেই পরিস্থিতি থেকে অব্যহতির কোন রাস্তা খোলা থাকবে না। চলমান কঠিন পরিস্থিতি ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করাটাই তোমার জন্য উত্তম যেখানে আল্লাহ তোমার দ্বীনকে নিরাপদ রেখেছেন"

আমি তাকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে নিন্দা করতে দেখলাম আর বলতে শুনলাম "জনগণের রক্ত পাত ঘটিও না; আমি এটাতে বিশ্বাস করিনা আর আমি কাউকে এটা করতে নির্দেশও দেই না" (আবু বকর আল-খাল্লাল, আস-সুন্নাহ ১/২৩২)
.
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, শাসকদের মধ্যে স্পষ্ট কুফরি প্রকাশ পাওয়া ও তার কুফরি সম্পর্কে স্পষ্ট অকাট্য দলীল বিদ্যমান থাকা ছাড়া সর্বাবস্থায় শাসকের কথা শোনা ও মানা আবশ্যক। ইসলাম সর্ববস্থায় রাষ্ট্রীয় জামা’আতকে আঁকড়ে ধরতে আদেশ দেয়। সর্বদা ঐকবদ্ধ থাকা সালাফগণের নীতি ও বৈশিষ্ট্য। কিছু হলে পরেই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেয়া ও সাধারণ নিরপরাধ মানুষের রক্ত প্রবাহিত করার অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয়নি। ইসলামী শরীয়াতে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কিছু প্রেক্ষাপট আছে, কিছু শর্ত রয়েছে। এসব প্রেক্ষাপট ও শর্তাবলি বাদ দিয়ে যে যার মত বিদ্রোহ ঘোষণা করলে রাষ্ট্রের মধ্যে যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে তা আর ঐসকল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তাই ইসলাম সর্বদা শাসকের কথা শোনা ও মানার দিকে উদ্বুদ্ধ করে। রাষ্ট্রীয় জামা’আতকে আঁকড়ে ধরার আদেশ দেয়। সকল বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিরোধ ও অনুৎসাহিত করে। সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য - পর্ব-০৩

Post a Comment

0 Comments