কে ই সাইয়েদ কুতুব? সাইয়েদ কুতুব কিভাবে খোমেনিকে অনুপ্রাণিত করেছেন

কে ই সাইয়েদ কুতুব? সাইয়েদ কুতুবের আকিদা ও তার সম্পর্কে ৮ জন আলেমের ফতওয়া পড়ুন!

সাইয়েদ কুতুবঃ (মিসর, ১৯০৬-১৯৬৬)


ইখোয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড), জামাতে ইসলামী, বোকো হারাম, আল-কায়েদাহ, আইসিস, হিযবুত তাওহীদ বা এমন অন্যান্য চরমপন্থী দলগুলোর আদর্শ গুরুদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তিত্ব হচ্ছে সাইয়েদ কুতুব।আদর্শগত কিছু ইখতেলাফ থাকলেও দ্বীন কায়েম, খিলাফত প্রতিষ্ঠা, ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে কথিত ‘ইসলামিক আন্দোলন’ এর মতাদর্শ প্রচারকারী সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে আরব বিশ্বের ৮ জন বড় আলেমদের ফতোয়ার ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো।
(১) শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ আজ থেকে ৩৩ বছর পূর্বে বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুবের সকল কিতাব ধ্বংস করা জরুরী।”
(২) শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুবের দ্বারা অনেকে ইসলামের দিকে উৎসাহিত হয়েছে, কিন্তু সে কোন আলেম ছিলোনা। সে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতো; কিন্তু কুরআন, সুন্নাহ ও সালফে সালেহীনদে আদর্শ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলোনা। তাকে রদ্দ করা ‘ওয়াজিব’, তবে সেটা নম্রভাবে করতে হবে।”
(৩) শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যদি আল্লাহর ভয় না থাকতো, তাহলে আমরা সাইয়েদ কুতুবকে তাকফীর করতাম।”
(৪) সাইয়েদ কুতুব বলেছিলো, “মুয়াবিয়া এবং তাঁর দুষ্কর্মের সাথী আ’মর ইবনে আস মিথ্যা, প্রতারণা, মুনাফেকী, ঘুষের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু আলী তাদের মতো এতো নীচে নামতে পারেন নি বলে তিনি তাদের সাথে জয়ী হতে পারেন নি।”
শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহকে সাইয়েদ কুতুবের এই কথার ব্যপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, “এটা কোন নিকৃষ্ট বাতিনি (শিয়া) অথবা কোন অভিশপ্ত ইয়াহুদীর কথা, কোন মুসলিম এমন কথা বলতে পারেনা।”
(৫) শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুব একজন জাহেল, তার জ্ঞান নেই, সে যা বলে তার কোন দলিল নেই। পূর্ব থেকে এখন পর্যন্ত আলেমরা সাইয়েদ কুতুবকে রদ্দ করে আসছেন।” (ক)
শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ আরো বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুব একজন জাহেল, একারণে (তার এমন কিছু যা কুফুরী, সেইগুলোর কারণে) তাকে তাকফির করা হবেনা।” (খ)
শায়খ ফাউজানকে সাইয়েদ কুতুবকে রদ্দ করে লেখা শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালীর বই “আদওয়া ইসলামিয়া আলা আকিদাত সাইয়েদ কুতুব ওয়াল ফিকরিহ” সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, “এই বইটা লেখা (দাওয়াতের জন্যে) খুব ভালো একটা কাজ এবং এর লেখক একজন মুহসিন।” (গ)
(৬) শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “আমরা আল্লাহকে ভয় করি এবং সাইয়েদ কুতুবকে তাকফীর করিনা, যদিও তার বইয়ে কিছু কঠোর কুফুরী কথা রয়েছে। যে ব্যক্তি সাইয়েদ কুতুবের বই প্রকাশ করে, সেগুলোকে সমর্থন ও প্রচার করার নীতি অবলম্বন করে, আমরা তার সমালোচনা করি। সে অনেক বড় গোমরাহীকে রক্ষা করছে।”
(৭) শায়খ উবায়েদ আল-জাবেরী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুব হচ্ছে কুতুবীদের ইমাম, আর কুতুবীরা হচ্ছে ইখোয়ানুল মুসলিমিনের একটা শাখা। সাইয়েদ কুতুবের লেখা কিতাব ‘ফী যিলালিল কুরআন’ আসলে হচ্ছে ‘ফী যিলালিল শায়তান’, কুরআনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমান যুগে (মুসলমান) সমাজ যে আত্মঘাতী বোমা হামলা, গুপ্ত হত্যা ও তাকফীরের মতো বিপর্যয়ের মোকাবেলা করছে, এর উৎস হচ্ছে সাইয়েদ কুতুব।”
(৮) শায়খ রামযান আল-হাজিরী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “খারেজীদের কথা বললে মানুষ মনে করে যেন অতীর যুগের ইতিহাস শুনছে। আসলে এখন তা ইতিহাস নয়, বরং খারেজী ফেতনাহ বাস্তব। এই খারেজী আকীদাকে জিন্দা করেছে এ যুগের ইখোয়ানুল মুসলিমীন (মুসলিম ব্রাদারহুড)। যাদের শিরোমনি ছিল হাসান আল-বান্না ও সাইয়েদ কুতুব। আর বর্তমান যাদের মূল হোতা হচ্ছে ইউসুফ আল-কারজাবী।” (ক)
শায়খ রামযান আল-হাজিরী হা’ফিজাহুল্লাহ আরো বলেছেন, “সাইয়েদ কুতুব বলেছেঃ বর্তমান যুগে কোন ইসলাম নেই, ইসলামের পতাকাবাহী কোন দল বা ব্যানার নেই এবং কোন ইসলামী ব্যবস্থা নেই। সাইয়েদ কুতুব হচ্ছে বর্তমান যুগের তাকফিরীদের ‘শায়খ’ (ধর্মগুরু বা আদর্শ নেতা), বরং সে তাদের জন্যে দলিল বা উৎস। তুমি কি জানো, সাইয়েদ কুতুব উসমান রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর খিলাফত সম্পর্কে কি মন্তব্য করেছে? সে বলেছেঃ উসমান রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর খিলাফত ইসলামী ইতিহাসে একটা শূণ্যস্থান (অর্থাৎ তা মোটেও ইসলামিক নয়)। আশ্চর্যের বিষয় হচ্চে, রাফেজীরা সাইয়েদ কুতুবের প্রশংসা করে এবং তার নামে ইরানে একটা রাস্তা নির্মান করেছে। এমনকি তাকে ইসলামী ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মর্যাদা দিয়ে তার ছবিসহ পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে। আমি শুনেছি খোমাইনির পুত্র সাইয়েদ কুতুবের প্রশংসা করে। এমনকি আমি এটাও শুনেছি যে, ওমানের খারেজীদের বড় একজন নেতা ও মুফতি যার নাম হচ্ছে আল-খালিলি, সে সাইয়েদ কুতুবের প্রশংসা করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাফেজী এবং খারেজীরা সাইয়েদ কুতুবকে ভালোবাসে। কিন্তু আমরা আল্লাহর জন্যে সাইয়েদ কুতুবকে ঘৃণা করি। সাইয়েদ কুতুব নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে কটু মন্তব্য করেছে (নাউযুবিল্লাহ)! আর এটাই হচ্ছে ইখোয়ানুল মুসলিমিনের মাদ্রাসা।” (খ)
_________________________
সাইয়েদ কুতুবের ভ্রান্ত আকীদাহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ
“মাওলানা মওদূদীর লেখনীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সাইয়েদ কুতুব একই ভাবধারায় তার লেখনী পরিচালনা করেছেন। সাথে সাথে তার অনুসারী দল ‘ইখওয়ানুল মুসলেমীন’ কেও সেইভাবেই পরিচালিত করেছেন। তিনিও খারেজীদের ন্যায় মুসলিম উম্মাহকে হয় কাফের নয় মুমিন, এভাবে দুই ভাগ করে বলেছেন, “লোকেরা আসলে মুসলমান নয়, যেমনটা তারা দাবী করে থাকে। তারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করছে। তারা ধারণা করে যে, ইসলাম এই জাহেলিয়াতকে নিয়ে চলতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধোঁকা খাওয়া ও অন্যকে ধোঁকা দেওয়ায় প্রকৃত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবেনা। না এটি ইসলাম এবং না তারা মুসলমান।” মাআ’লিম ফিত-তারীক্ব পৃঃ ১৫৮।
সাইয়েদ কুতুব আরো বলেছিলেন, “কালচক্রে দ্বীন এখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহতে এসে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে ও পশ্চিমের মানুষ সর্বত্র মসজিদের মিনার সমূহে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করে কোনরূপ বুঝ ও বাস্তবতা ছাড়াই। এরাই হলো সবচেয়ে বড় পাপী ও কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তির অধিকারী। কেননা তাদের কাছে হেদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এবং তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে থাকার পরেও তারা মানুষ পুঁজার দিকে ফিরে গেছে।” সাইয়িদ কুতুবের লেখা তাফসীর ফী যিলালিল কুরআ’ন, সুরা আনআ’মঃ আয়াত ১৯ এর ব্যাখ্যা, ২/১০৫৭ পৃঃ।
সাইয়েদ কুতুব আরো বলেন, “বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই বা কোন মুসলিম সমাজ নেই।” ফী যিলালিল কুরআ’ন, সুরা হিজরের ভূমিকা, ৪/২১২২ পৃঃ।
বর্তমান যুগে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত মসজিদগুলিকে কুতুব “জাহেলিয়াতের ইবাদতখানা” বলে আখ্যায়িত করেছেন (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক!)। ফী যিলালিল কুরআ’ন, ইউনুস, ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যা ৩/১৮১৬।
সাইয়েদ কুতুব মাওলানা মওদূদীর ন্যায় ‘আল্লাহর ইবাদত’ ও ‘সরকারের আনুগত্যকে’ সমান মনে করেছেন এবং অনিসলামিক সরকারের আনুগত্য করাকে ‘ঈমানহীনতা’ গণ্য করেছেন। ফী যিলালিল কুরআ’ন, সুরা নিসা ৬০ আয়াতের ব্যাখ্যা, ২/ ৬৯৩ পৃঃ।
একটি মাত্র বিষয়েও অন্যের অনুসরণ করলে সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিয়ে (কাফের হয়ে) যাবে বলে তিনি ধারণা করেছেন। ফী যিলালিল কুরআ’ন, ২/৯৭২ পৃঃ।
তিনি বলেন, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য হলো, ইসলাম বিরোধী শাসনের বুনিয়াদ ধ্বংস করে দেয়া এবং সে স্থলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করা। ফী যিলালিল কুরআ’ন, ৩/১৪৫১ পৃঃ।
এভাবে আলেমগণ সাইয়েদ কুতুবের অন্যান্য বই ছাড়াও কেবলমাত্র তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন’ এ আক্বীদাগত ও অন্যান্য বিষয়ে ১৮১ ভুল চিহ্নিত করেছেন। মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল-হুসাইন, ফিৎনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকেমিয়াহ, পৃঃ ৯৮।
মাওলানা মওদূদী ও সাইয়িদ কুতুবের চিন্তাধারার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের তারা মুসলমান মেনে নিতে চাননি। বরং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলে ধারণা করেছেন। এর ফলে তারা সাহাব্যে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সাথে সাথে পদচ্যুত করেছেন তাদের অনুসারী অসংখ্য মুসলিমকে। অথচ এর কোন বাস্তবতা এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও ছিল না। তখনও মুসলমানদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ফাসিক-মুনাফিক সব ই ছিল। কিন্তু কাউকে তারা কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলতেন না। সেকারণ আধুনিক যুগের আলেমগণ এসব দল ও এদের অনুসারী দলসমূহকে এক কথা “জামাতুত তাকফীর” অর্থাৎ “অন্যকে কাফের ধারণাকারী চরমপন্থী দল” বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ এইসব চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন। অতএব, সকলের কর্তব্য হবে সর্বাবস্থায় আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজে বাধা দেওয়ার) মৌলিক দায়িত্ব পালন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।
উৎসঃ ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ পৃঃ ৫৩-৫৫।
সংকলনঃ ড. মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব।
_________________________
wikipedia.বিস্তারিত
ফতোয়া সমূহের উৎসঃ--- 
(১) শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ
.
(২) শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ
.
(৩) শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ
.
(৪) শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ
.
(৫) শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ
.
(৬) শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালী হা’ফিজাহুল্লাহ
.
(৭) শায়খ উবায়েদ আল-জাবেরী হা’ফিজাহুল্লাহ
.
(৮) শায়খ রামযান আল-হাজিরী হা’ফিজাহুল্লাহ

  <<<<<->
 
<<<>>>সাইয়েদ কুতুব কিভাবে খোমেনিকে অনুপ্রাণিত করেছেন?/>>

আবদুল্লাহ তামিম: সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-২৫ আগস্ট ১৯৬৬) হলেন একজন মিশরীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠক।

তিনি মিশরের ইসলামি আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলের মুখপত্র ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ এর সম্পাদক ছিলেন। তাকে তৎকালীন সরকার ফাঁসির আদেশ দেয় এবং ফাঁসির কাষ্ঠেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সালের ৯ অক্টোবর মিসরের উসইউত জেলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম সাইয়েদ, কুতুব তার বংশীয় উপাধি।

তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিশরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তার বাবার নাম হাজি ইবরাহীম কুতুব; তিনি চাষাবাদ করতেন।

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হেফয করেন। পরবর্তীকালে তার বাবা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

সাইয়েদ কুতুব তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষা শেষ করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদরাসা থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি পড়াশুনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

তিনি দু’বছরের র্কোস শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকা থাকাকালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।

১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী- ইখওয়ানুল মুসলিমুন এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। কারণ, ওই বছর মিসর সরকার ব্রিটিশের সাথে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে।

পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। একটি হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করেন।

১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাকে মুক্তি দিয়ে তারই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।

এক বছর যেতে না যেতেই তাকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন।

শুধু তিনি নন, তার ভাই মুহাম্মদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাত শ’ ছিলেন নারী।

১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় সদস্য সাইয়েদ কুতুবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।

মিশরের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের হত্যার পরিকল্পনা করার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।

কুতুবকে আধ্যাত্মিক নেতা ও বিপ্লবী ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রথম তাত্ত্বিক হিসেবে বিবেচনা করা হত, যারা অস্ত্রের অধিকার আদায়ের জন্য এবং বিদ্যমান বাস্তবতা পরিবর্তন করার জন্য একটি সমাধান হিসেবে সহিংসতা অবলম্বন করার আহ্বান জানায় তারা তাকে শত্রু মনে করতো।

তিনি শরিয়াহ শাসন এবং অন্যান্য বিষয়কে সহজি করণের চিন্তা করে সামাজিক অনেক কাজ করেন। যার কারণে তিনি আজো অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।

সাঈদ কুতুব সমসাময়িক শিয়া ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তাধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছেন। তার প্রচারে সহিংসতা ও চরমপন্থার কোনো অবস্থান ছিলো না। বরং তার চিন্তা চেতনার দ্বারা চিহ্নিত বিভিন্ন শিয়া ইসলামি আন্দোলনের ধারণা ও নীতিসমূহের ধারণার সঙ্গে মিল থাকায় শিয়া সম্পর্কের এক নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করেছিল।

তার বই ও প্রবন্ধগুলো শিয়া মতাবলম্বিদের একটি অনুপ্রেরণার বিষয়ে পরিণত হয়। এদিকে খোমেনিকে শিয়ারা যে ইমাম মনে করে সেটা সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা চেতনার অনেক দিকে মিল পেয়েছে শিয়া মতাবলম্বিরা। যার কারণে তারাও তাকে গুরুত্বের আসনে সমাসিন করেছিলেন।

তার বই ‘ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার’ শিরোনামে, তিনি উসমান বিন আফফান ও আবু সুফিয়ান বিন হারব, আমর ইবনুল আসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির সমালোচনা করেছেন। যেটা শিয়াদের মতের পক্ষে যায়।

একই বইয়ে কুতুব শিয়া আন্দোলনের প্রশংসা করেন, যা শিয়া আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। চতুর্থ শতাব্দীর (হিজড়ার পর) আব্বাসীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কুতুব এ আন্দোলনকে ইসলামের আত্ম প্রকাশ বলে উল্লেখ করে বলেন, এ লড়াই ছিলো শোষণ ও ক্ষমতা গ্রহণের লড়াই।

প্রথম সাক্ষাত

সাইয়েদ কুতুব ও ইমাম খোমেনির মধ্যকার প্রথম বৈঠক ও সমসাময়িক শিয়া পণ্ডিতদের একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করে যা ঘটেছিলো ১৯৫৩ সালে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মিশরীয় বুদ্ধিজীবী ইরানের সাইদ মুজতবা মীর লোহি যিনি পরিচিত সাফি নামে।

সিরিয়ার গবেষক রসাস লিখেছেন, খোমেনি ও সাইয়েদ কুতুবের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। মিশরের নানান বড় বড় অনুষ্ঠানে কুতুব নিজেই মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় অবস্থানের কারণে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।

ইরানের ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হামিদ গারিব রেজা বলেন, এ সফরটি মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাদের দুই নেতার একত্রিত সফরটি ছিলো ব্যতিক্রমর্ধী একটি সফর।

সমসাময়িক শিয়া আন্দোলনে সাইয়েদ কুতুবের চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাব বিশিষ্ট ইরাকি চিন্তাবিদ মুহাম্মদ বাকির আল-সদরের লেখায় ফুটে উঠে।

১৯৬৪ সালে প্রথম দফায় যখন তিনি কারাগারে ছিলেন তখন সাইয়েদ কুতুবের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন মুহাম্মদ বাকির আল-সদর ইরাকি রাষ্ট্রপতি আবদুস সালাম আরিফকে মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদুন নাসেরের সঙ্গে কুতুবকে মুক্ত করার আহ্বান জানান।

কারাগারে সাইয়েদ কতুব

১৯৬৯ সালে, ইরান বিপ্লবের নেতা ও শিয়াদের ইমাম- খোমিনি, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বই ‘ইসলামি সরকার’ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

কুতুবের মৃত্যুদণ্ডের তিন বছর পর এটা প্রকাশ হয়। তখন এটা অনেক পণ্ডিতদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। যারা খোমেনি ও কুতুব উভয়ের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখেনি তাদের ধারণা স্পষ্ট করেছে।

এটাও বল হয়েছে, খোমেনি মিশরীয় চিন্তাবিদদের লেখাগুলির সাথে পরিচিত হতে পারে। তার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। একটি ধর্মীয় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে পথনির্দেশ করে যে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় সেগুলোর বহি:প্রকাশ ছিলো তার এ বই।

বর্তমান ইরানি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি, সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা ও তার দর্শনে অনুপ্ধারাণিত বলে মনে করা হয়।

খোমেনির আদেশে তার কিতাবগুলোর অনুবাদ করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। তিনিও তার অনেক কিতাবের ওপর আলোকপাত করেছেন। সাইয়েদ কুতুব শহিদ অনেক গ্রন্থ লিখেছেন।

সাইয়েদ কুতুব মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যিকদের সিংহ পুরুষ হিসেবে খ্যাত। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবিদের কাহিনী লিখে তার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাটা) নামে ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট একটি উপন্যাস রচনা করে বিশ্বব্যাপী সমাদ্রিত হন।

তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মুশাহিদুল কিয়ামাহ ফিল কুরআন, আত্ তাসবিরুল ফান্নি ফিল কুরআন, আল আদালাতুল ইজতিমাঈয়া ফিল ইসলাম, ফি যিলালিল কুরআন ইত্যাদি প্রসিদ্ধ।

সূত্র: আল আরাবিয়া ও উইকিপিডিয়া