মউদুদি কি গোপন শিয়া?,



"যে ইতিহাস সাহাবীদের গায়ে কলঙ্কের কালি লেপন করে, সেই ইতিহাস কখনোই ('আহেল'সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের') নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা,,

"আমি প্রথম যখন মাওলানা মওদূদী সাহেবের 'খিলাফত ও মুলুকিয়াত' বইটি পড়ি, তখন মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর উপর খুবী রাগান্বিত ছিলাম! মাঝেমধ্যে এটাও ভাবতাম যে, কিভাবে এরকম একজন লোক রাসুলের সাহাবী হতে পারেন?
_
"তারপর যখন যাচাই বাছাই করে দেখলাম; মওদূদী সাহেব এমন মিথ্যাচার করেছেন! খারেজী-শীয়ারাও থাকে হার মানবে।

"গত কিছুদিন আগে রাজতন্ত্র নিয়ে জবাব দিয়ে একটি পোস্ট করেছিলাম। সেখানে আমাদের জামায়াতী ভাইয়েরা এমন ক্ষেপা ছিল! মুয়াবিয়া (রাঃ)-কে গালিগালাজ শুরু করলো। অথচ হালাল জিনিসকে জোর করে হারাম মনে করেতে যেয়ে মুয়াবিয়া রাঃ এর মতো ওহির কাতেব জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত একজন সাহাবিকে গালাগাল করার অাগে নিজেদের ঈমান নিয়ে কেউ চিন্তা করলেন না! মওদুদি হয়ে গেলো ওহি লেখক মুয়াবিয়া রাঃ থেকে বেশি অাপন ও বিশ্বস্ত! কিভাবে সম্ভব! কেউ কি ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করেছেন, মওদুদি অাপনাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

"ভাবলাম এরা মওদূদী সাহেবের 'বই' পড়ে এতোই গুমরাহ হয়েছে, একজন সাহাবীকেও গালিগালাজ করতে তাদের দ্বিধাবোধ করেনি। তাই তাদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যই আমার পোস্ট।

___"মওদূদী সাহেবের মিথ্যাচার নিম্নরূপঃ-

"গণীমতের অর্থ আত্মসাৎ
_
"মাওলানা মওদূদীকে আল্লাহ পাক মাফ করুন , উপরের গুরুতর অভিযোগ প্রসংগে তিনি লিখেছেন— "গণীমতের মাল তকসীমের ক্ষেত্রেও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কুর’আন সুন্নাহর সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করেছেন । শরীয়তের নির্দেশ মুতাবেক মালে গণীমতের এক পঞ্চমাংশ জমা হবে বাইতুল মালে এবং অবশিষ্ট মাল তকসীম হবে মুজাহিদদের মাঝে। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া গণীমতলব্ধ সোনা-চাঁদি তার জন্য পৃথক রেখে অবশিষ্ট মাল শরীয়ত মুতাবেক তকসীম করার নির্দেশ জারী করলেন”
_
"এ অভিযোগ সমর্থনে মাওলানা সাহেব মোট ৫'টি উৎসগ্রন্থের বরাত টেনেছেন। তারমধ্যে পঞ্চমটি হলো আল বিদায়া আল নিহায়া ('খঃ ৮ পৃ ২৯')
_
"এখানে আমরা আল বিদায়ার মূল উদ্ধৃতি তুলে ধরছি— "এ বছরই যিয়াদের নির্দেশে তার অধীনস্থ হযরত হাকাম বিন আমর খোরাসানের ‘জাবাল আল আসল’ অঞ্চলে জিহাদ পরিচালনা করলেন। তাতে বিপুল শত্রু নিহত হলো এবং বিপুল সম্পদ হস্তগত হলো। যিয়াদ তখন হযরত হাকাম বিন আমরকে লিখে জানালেন, 'আমীরুল মুমিনীনের চিঠি এসেছে, যেনো যাবতীয় সোনা-চাঁদি তার জন্য আলাদা রেখে দেয়া হয়। এগুলো বাইতুল মালে জমা হবে” উত্তরে হযরত হাকাম বিন আমর লিখে পাঠালেন। “আমীরুল মুমিনীনের চেয়ে আল্লাহর নির্দেশই বড়। আল্লাহর কসম! আসমান যমিন যদি কারো দুশমন হয়ে যায়; আর সে শুধু আল্লাহকেই ভয় করে তাহলে তার জন্য আল্লাহ কোন না কোন উপায় অবশ্যই করে দেবেন, অতঃপর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বললেন; “গণীমতের মাল তোমরা তকসীম করে ফেলো।,,
_
"মোটকথা; হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর নামে যিয়াদ তাঁর কাছে যে, নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তিনি তা অগ্রাহ্য করে শরীয়তের নির্দেশ মুতাবেক গণীমতের এক পঞ্চমাংশ বাইতুল মালের জন্য রেখে বাকিটা মুজাহিদদের মাঝে তকসীম করে দিলেন। এখানে মাওলানা মওদূদী কতটা বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন সে বিচার ভার রইলো পাঠকের হাতে।
_
"আমরা শুধু আল- বিদায়ার উদ্ধৃতি ও মাওলানার বক্তব্যের মাঝে অত্যন্ত নগ্নভাবে যে কয়টি পার্থক্য ধরা পড়ে তা তুলে ধরছি; আল-বিদায়ার মতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) নিজের জন্য নয়, বরং বাইতুল মালের জন্যেই এ নির্দেশ জারী করেছিলেন।
_
"হাফেয ইবনে কাছীর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন— এই গণীমতের যাবতীয় সোনা চাঁদি বাইতুল মালে জমা করা হবে। অথচ ইবনে কাছীরের বরাত টেনেই মাওলানা হুজুর লিখেছেন— “হযরত মুয়াবিয়া গণীমতের সোনা-চাঁদি তার নিজের জন্য পৃথক করে রাখার নির্দেশ জারী করলেন।”
_
"আমরা সত্যি হতবুদ্ধি ; এ ধরনের নগ্ন গরমিলের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? সংযত ভাষায় শুধু বলা যায়, ‘গবেষণা’ এমন অসতর্ক মানুষের জন্য নয়। মওদূদী সাহেবের বক্তব্য থেকে মনে হয়, প্রদত্ত বরাতগ্রন্থগুলোতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ কোন নির্দেশ দেখেই বুঝি তিনি এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন। অথচ আল- বিদায়াসহ কোথাও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর প্রত্যক্ষ নির্দেশের কোন উল্লেখ নেই।
_
"ইতিহাস আমাদের শুধু এইটুকু বলে যে, যিয়াদ তার অধীনস্থকে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর নাম ব্যবহার করে নির্দেশ পাঠিয়েছিলো । সত্যি সত্যি এ বিষয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর কোন নির্দেশ ছিলো কি না? সে নির্দেশের ভাষা কী ছিলো? উদ্দেশ্যই বা কী ছিলো? সে সম্পর্কে ইতিহাস সম্পূর্ণ নীরব।
_
"তর্কের খাতিরে না'হয় মেনে নেয়া গেলো; হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হয়ত কোন নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন এবং যিয়াদও সে নির্দেশের শব্দ, ভাষা ও উদ্দেশ্য অনুসরণের ক্ষেত্রে পূর্ণ সততা রক্ষা করেছিলো। কিন্তু তারপরও এমন তো হতে পারে যে , বাইতুল মালে তখন সোনা-চাঁদির ঘাটতি ছিলো এবং কোন সূত্রে 'আমীরুল মুমিনীন জানতে পেরেছিলেন যে, উক্ত জিহাদের সোনা-চাঁদি মোট গণীমতের এক পঞ্চমাংশের অধিক নয়; তাই তিনি বাইতুল মালের ঘাটতি পূরণের জন্য অন্যান্য সামগ্রীর পরিবর্তে শুধু সোনা-চাঁদি পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।
_
"পক্ষান্তরে হযরত হাকাম বিন আমরের ক্ষোভ প্রকাশের কারণ সম্ভবতঃ এই যে, প্রকৃতপক্ষে উক্ত গণীমতের সোনা-চাঁদি এক পঞ্চমাংশের অধিক ছিলো। ফলে যিয়াদের মাধ্যমে প্রাপ্ত উক্ত নির্দেশ তাঁর কাছে কিতাবুল্লাহর পরিপন্থি মনে হয়েছিলো।
_
"মোটকথা; এ অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে ঐতিহাসিক বর্ণনার গ্রহণযোগ্য অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। এবার আপনি নিজেই বুকে হাত দিয়ে বলুন; আজ তেরশ বছর পর ইতিহাসের নীরবতা উপেক্ষা করে এবং যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাশ কাটিয়ে কেন আমরা সাহাবা-চরিত্রে এমন জঘণ্য কলংক লেপন করতে যাই?
_
"সর্বোপরি এটা ছিলো বিশেষ এক ক্ষেত্রে আমীরুল মুমিনীনের সাময়িক নির্দেশ মাত্র। অথচ মওদূদী সাহেবের মন্তব্য পড়ে মনে হবে; বুঝি বা এটা জিহাদ ও গণীমত বিষয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর নীতিনির্ধারণী নির্দেশ। আর তাই মাওলানা মন্তব্য ছুঁড়েছেন যে, গণীমতের মাল তকসীমের ক্ষেত্রেও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কুর’আন সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ করে ধর্মহীন রাজনীতির গোড়াপত্তন করেছেন।
_
"মওদুদী সাহেবের সর্বশেষ ত্রুটি এই যে, হযরত মুয়াবিয়ার নামযুক্ত নির্দেশটি তিনি উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু সে নির্দেশ পালিত হয়েছিলো কি না সে কথা তিনি বেমালুম চেপে গেছেন। অথচ একই বর্ণনার শেষাংশে হাফেয ইবনে কাছীর সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন— “হযরত মুয়াবিয়ার নামযুক্ত নির্দেশের ব্যাপারে তিনি যিয়াদকে অমান্য করলেন”

দেখুনঃ ইবনে কাছীর বলেছেন, হযরত হাকাম যিয়াদকে অমান্য করেছেন। মুয়াবিয়া (রাঃ)-কে অমান্য করেছেন—এ কথা তিনি বলেননি । ইবনে কাছীর কেন এমনটি করলেন? মাওলানা মওদূদীও কি এই বুদ্ধিবৃত্তিক সততাটুকু দেখাতে পারতেন না?
__________________________________________

"দিয়তের অর্থ আত্মসাৎ
-

"এই অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য মাওলানা মওদূদী সাহেব লিখেছেন— “হাফেয ইবনে কাছির বলেন; দিয়তের ক্ষেত্রেও হযরত মুয়াবিয়া সুন্নতে হস্তক্ষেপ করেছেন। সুন্নত মোতাবেক চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ('যিম্মির') দিয়ত বা রক্তপণ মুসলমানের বরাবর হওয়ার কথা। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া তা অর্ধেকে নামিয়ে এনে বাকি অর্ধেক নিজেই নেয়া শুরু করলেন। ('পৃঃ ১৭৩-১৭৪')
_
"আল বিদায়ার মূল উদ্ধৃতি দেখুন— “একই সূত্রে ইমাম যুহরীর বক্তব্য আমরা পেয়েছি যে, সুন্নত ছিলো এই চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের দিয়ত মুসলমানের বরাবর হবে। হযরত মুয়াবিয়াই প্রথম ব্যক্তি যিনি তা অর্ধেকে হ্রাস করে বাকি অর্ধেক নিজের জন্য নেয়া শুরু করলেন। ( ৮'খণ্ড পৃঃ ১৩৯ )
_
"শুরুতেই আমাদের দুইটি সংশোধনী দিতে হচ্ছে। প্রথমতঃ “দিয়তের ক্ষেত্রেও হযরত মুয়াবিয়া সুন্নতে হস্তক্ষেপ করেছেন! এ বাক্যটা মাওলানা সাহেবের নিজস্ব সংযোজন। ইবনে কাছীর বা ইমাম যুহরী কেউ এ কথা বলেননি। ('তাহলে কেন উনি নিজের মনগড়া কথা ডুকালেন?')
_
"দ্বিতীয়তঃ সম্পূর্ণ মন্তব্যটা ইবনে কাছীরের নয়; বরং ইমাম যুহরীর বরাত দিয়ে তিনি তা বর্ণনা করেছেন মাত্র। অথচ মওদূদী সাহেব এটাকে ইবনে কাছীরের মন্তব্যরূপে বিবৃত করেছেন। সম্ভবতঃ এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সততার পরিপন্থি, যা কোন দায়িত্বশীল গবেষকের পক্ষে শোভনীয় নয়।
_
"যাই হোক, মওদূদী সাহেব ইমাম যুহরীর শেষোক্ত বাক্যের তরজমা করেছেন— আর বাকিটা তিনি নিজেই নেয়া শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যদি দয়া করে যে কোন প্রামাণ্য হাদীসগ্রন্থ খুলে দেখার কষ্টটুকু স্বীকার করতেন তাহলে এ ধরনের সহজ ভ্রান্তির শিকার তিনি হতেন না এবং আল্লাহর রাসূলের ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) সাহাবীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মত সংগীন অভিযোগ উত্থাপনেরও প্রয়োজন দেখা দিত না। কিন্তু তিনি তা করেন নি।
_
"দেখুন ; বায়হাকী শরীফে ইমাম যুহরীর বর্ণনায় এভাবে এসেছে— ''বাকি অর্ধেক তিনি বাইতুল মালে জমা করলেন'' ('খঃ ৮ পৃঃ ১০২ - প্রকাশক দাইরাতুল মায়ারিফ, উসমানিয়া, হায়দরাবাদ') সুতরাং “অর্থ নিজের জন্য নেয়া শুরু করলেন” কথাটার অর্থ হলো; তিনি তাঁর দায়িত্বে অর্পিত বাইতুল মালের জন্যে নেয়া শুরু করলেন , ব্যক্তিগত খরচের জন্য নয়।
_
"হযরত মুয়াবিয়া ( রাঃ ) এর উপরোক্ত সিদ্ধান্তের কারণ এই যে, এ বিষয়ে দুই ধরনের হাদীস আছে। ফলে সাহবাদের মাঝেও বিষয়টি বিরোধপূর্ণ ছিলো। এক হাদীসে বলা হয়েছে— “কাফিরের দিয়ত হবে মুসলমানের দিয়তের অর্ধেক” ('মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ') - এ হাদীসের আলোকে হযরত উমর বিন আবদুল আযীয ও ইমাম মালিক অমুসলিম যিম্মির দিয়ত মুসলিম দিয়তের অর্ধেক বলে মত প্রকাশ করেছেন। ('নায়লুল আওতার, বিদায়াতুল মুজতাহিদ')
_
"পক্ষান্তরে হযরত ইবনে উমর— বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইরশাদ হচ্ছে— “যিম্মির দিয়ত মুসলিম দিয়তের অনুরুপ” ('বায়হাকী খঃ ৮ পৃঃ ১০২')
_
"এ হাদীসের সূত্র ধরেই ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম সুফিয়ান সাওরী যিম্মী – মুসলিম উভয় ক্ষেত্রে অভিন্ন দিয়তের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ('নায়লুল আখতার খঃ'৭ পৃঃ ৬৫')
_
"কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) উভয় হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে নিজস্ব ইজতিহাদ প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে অর্ধেক দিয়ত নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী পাবে; বাকি অর্ধেক জমা হবে বাইতুল মালে। এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন— “নিহত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়রা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তেমনি ('যিযিয়া কর থেকে বঞ্চিত হয়ে') বাইতুল মালও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সুতরাং দিয়তের অর্ধেক ('পঁচিশ দীনার') উত্তরাধিকারীদের দিয়ে বাকি অর্ধেক বাইতুল মালে জমা করো। ('বাইহাকী খঃ ৮ / ১০২')
_
"প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর সাথে ভিন্নমত পোষণের অধিকার একজন মুজতাহিদের অবশ্যই আছে। কিন্তু নিরপেক্ষ ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে; যে প্রশংসনীয় সূক্ষ্মধর্মিতার সাথে বিপরীত দুইটি হাদীসের মাঝে তিনি সমন্বয় সাধন করেছেন তা হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অগাধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই পরিচায়ক।
_
"অথচ এই অনুপম ইজতিহাদকেই মওদূদী সাহেব হারাম-হালালের তফাত ও আইনের শাসন বিলুপ্ত করার
'পলিসি' প্রমাণের অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নৌবহর- নির্মাতা সাহাবীর ভাগ্যে আজ তেরশ বছর বাদে এ পুরস্কারই জুটলো মুসলিম জাহানের “স্বনামধন্য” এই “গবেষকের” হাতে।
_
"এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো যে , ইমাম যুহরী হযরত মুয়াবিয়া ( রাঃ ) কেই দিয়তের বিধানে পরিবর্তনসাধনকারী রূপে চিহ্নিত করেছেন বটে, কিন্তু তার সাথে ভিন্নমত পোষণের যথেষ্ঠ অবকাশ রয়েছে। দুইটি বিপরীতমুখী হাদীসের আলোচনা তো এইমাত্র হলো। হযরত উমর ( রাঃ ) ও হযরত উসমান ( রাঃ ) সম্পর্কেও পরস্পরবিরোধী বর্ণনা রয়েছে। এমনকি কোন কোন রিওয়ায়েত মতে তাঁদের আমলে যিম্মির দিয়ত ছিলো মুসলিম দিয়তের এক- তৃতীয়াংশ মাত্র। এ জন্যই ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) অনুরূপ মত গ্রহণ করেছেন।
________________________________________

"মুয়াবিয়া'কে বিদ'আতী সাব্যস্ত করা,,
_
"আইনের শাসন বিলোপ’
শিরোনামে মাওলানা মওদূদী সাহেব লিখেছেন— ‘এই বাদশাহদের রাজনীতি দ্বীনের অনুগত ছিলো না এবং হালাল-হারামের কোন তমিজ ছিল না। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বৈধাবৈধ সব পন্থাই তারা অবলম্বন
করতেন।
_
"বিভিন্ন উমাইয়া খলীফার শাসনকালে আইনের প্রতি আনুগত্যের স্বরূপ কী ছিল এখানে আমরা তা আলোচনা করবো। ‘বস্তুতঃ হযরত মুয়াবিয়ার শাসনামলেই এ ‘পলিসের’ সূত্রপাত ঘটেছিল। এই দাবীর স্বপক্ষে মওদূদী সাহেব মোট ছয়টি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
_
"প্রথম ঘটনা সম্পর্কে তার ভাষ্য— ‘ইমাম যুহরী বর্ণনা করেন— 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম' ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত ('শরীয়তি-বিধান') মোতাবেক কাফির ও মুসলমান পরস্পরের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী হতে পারতো না। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া কাফিরকে মুসলমানের উত্তরাধিকারী না'করলেও মুসলমানকে কাফিরের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয খলিফা হয়ে এ ‘বিদ’আত’ বিলুপ্ত করলেন।
_
"কিন্তু হিশাম বিন আবদুল মালিক খলীফা হয়ে নিজেদের খান্দানী প্রথা পুনরুজ্জীবিত করলেন। এ অভিযোগের স্বপক্ষে তিনি ইতিহাস শাস্ত্রের উৎসগ্রন্থ “আল- বিদায়া ওয়াল নিহায়া” এর বরাত দিয়েছেন।
_
"সুতরাং প্রথমে মূল গ্রন্থের উদ্ধৃতি ভালভাবে লক্ষ্য করুন— “ঈমাম যুহরী বর্ণনা করেন; 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম' ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মুসলমান ও কাফির পরস্পরের উত্তরাধিকারী হতো না। পরে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কাফিরকে মুসলমানের উত্তরাধিকারী না করলেও মুসলমানকে কাফিরের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন। পরবর্তী খলিফাগণ সে ধারা অব্যাহত রাখলেন, কিন্তু হযরত উমর বিন আবদুল আযীয খলিফা হয়ে পূর্ববর্তী ‘সুন্নতটি’ পুনর্বহাল করলেন।
_
"পরবর্তী খলীফা ইয়াযীদ বিন আবদুল মালিকও তার অনুসরণ করলেন। কিন্তু খলিফা হিশাম আবার পূর্ববর্তী
খলীফাদের ‘সুন্নত’ গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ মুসলমানকে তিনি কাফিরের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন। (আল-বিদায়া ওয়া নিহায়াহ খঃ ৯'পৃঃ ২৩২'পৃষ্ঠা')
_
"এবার আসল সুরতেহাল প্রত্যক্ষ করুন। মূলতঃ এটা হলো ফিকহশাস্ত্রের একটি বিরোধপূর্ণ মাসয়ালা। সাহাবাগণের মাঝেও এ বিষয়ে মতানৈক্য ছিলো।
হানাফী মাযহাবের ফকীহ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী
লিখেছেন— ‘গরিষ্ঠসংখ্যক সাহাবার মতে মুসলমান কাফিরের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। হানাফী উলামা ও
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এ মত গ্রহণ করেছেন। এটা হলো সূক্ষ কিয়াস। পক্ষান্তরে হযরত মুয়ায বিন জাবাল
(রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর মাযহাব মতে মুসলমান কাফিরের উত্তরাধিকার পাবে।
_
"সাধারণ কিয়াসের দাবী অবশ্য তাই। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম মাসরূক, হাসান বসরী, মুহাম্মদ বিন হানাফিয়া ও মুহাম্মদ বিন হোসায়ন প্রমুখ এ মতের অনুসারী। ('উমদাতুল কারী খঃ ১৩ পৃঃ ২৬০, অধ্যায়ঃ মুসলিম- কাফির উত্তরাধিকার')
_
"শাফেয়ী মাযহাবের হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) লিখেছেন— ‘ইবনে আবী শায়বা হযরত আবদুল্লাহ
বিন মা’কিলের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন; আর কোন সিদ্ধান্ত আমার কাছে হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ)-এ সিদ্ধান্ত থেকে উত্তম মনে হয় নি যে, আমরা আহলে কিতাবের উত্তরাধিকারী হবো, কিন্তু ওরা আমাদের উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। যেমন ওদের নারীদের আমরা বিয়ে করতে পারি, অথচ ওরা তা পারে না। ইমাম ইসহাক এ মতের অনুসারী।
_
"হযরত মু’য়ায বিন জাবাল (রাঃ)- বর্ণিত এই হাদীসটি তাঁর ও হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) স্বপক্ষে এক মযবুত দলীল। “ইসলাম বৃদ্ধি করে, হ্রাস করে না। ('সুতরাং ইসলামের কারণে কেউ মীরাস থেকে বঞ্চিত হতে পারে না') ঈমাম আবূ দাউদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আর ঈমাম হাকীম তা সহীহ বলে রায় দিয়েছেন। ('ফতহুল বারী, খঃ ১২ পৃঃ ৪১ অধ্যায়ঃ মুসলিম- কাফির
উত্তরাধিকার')
_
"মওদূদী সাহেবের বর্ণনায় এমনকি সচেতন পাঠকও ভাবতে পারেন যে, এটা হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) একক সিদ্ধান্ত এবং ('আল্লাহ না করুন') ইজতিহাদের ভিত্তিতে নয়, বরং নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে একটি বিদ’য়াত জারীর মাধ্যমে তিনি আইনের মর্যাদা লুন্ঠিত করেছেন।
_
"অথচ এই মাত্র আপনি দেখে এলেন, এটি ফিকহশাস্ত্রের ইজতিহাদভিত্তিক একটি মাসয়ালা মাত্র। তদুপরি
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মু’য়ায বিন জাবালও ( রাঃ ) এ বিষয়ে একমত পোষণ করতেন। আর তাঁর সম্পর্কে
আল্লাহর রাসূলের ('সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম') ইরশাদ হলো— 'হালাল- হারামের ব্যাপারে সাহাবাদের মাঝে মু’য়ায বিন জাবাল বেশী জানেন।” ('তিরমিযী, মিশকাত, বাবুল মানাকিব')
_
"তদ্রুপ এ মত পোষণকারীদের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন ইমাম মাসরূক, ঈমাম হাসান বসরী, ঈমাম ইবরাহীম নাখয়ী, ঈমাম মুহাম্মদ বিন হানাফিয়া ও ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী বিন হোসায়নের মত বিশিষ্ট তাবেয়ী। সর্বোপরি তাদের ইজতিহাদের ভিত্তি হচ্ছে একটি সহীহ হাদীস। এটা ঠিক যে, পরবর্তী যুগের ফকীহগণ
হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। আমরাও ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সিদ্ধান্তের পক্ষে
নই। তবে আমরা বিশ্বাস করি যে, মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদকে বিদ’য়াত বলার অধিকার নেই কোন ভদ্রলোকের। অধিকার নেই এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপনের যে, হালাল- হারামের তফাত মিটিয়ে
দিয়ে ধর্মহীন রাজনীতির ‘ পলিসি ’ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
_
"হযরত আলী (রাঃ) এর সাথে রাজনৈতিক মতানৈক্যের ‘অপরাধে’ আল্লাহর রাসূলের ('সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম') প্রিয় সাহাবীকে ইজতিহাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে শাস্তি মওদূদী সাহেব দিলেন! তার
যৌক্তিকতা হযম করা আমাদের মত উম্মী লোকের পক্ষে সত্যি সম্ভব নয়।
_
"মওদূদী সাহেবের হয়তো জানা নেই যে, সাহাবী মুয়াবিয়া (রাঃ) যেমন সুদক্ষ শাসক ছিলেন তেমনি ফকীহ ও উচ্চস্তরের মুজতাহিদও ছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস
(রাঃ) কিন্তু তা জানতেন।
_
"বুখারী শরীফ কি বলে দেখুন— ‘হযরত ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করা হলো; আমীরুল মু’মিনীন মুয়াবিয়া (রাঃ) এক রাকায়াত বিতর পড়ে থাকেন। এ
সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? উত্তরে তিনি বললেন; ঠিকই করেছেন। তিনি তো একজন ফকীহ। ('বুখারী শরীফ')
_
"মজার ব্যাপার এই যে, মওদূদী সাহেব যার মন্তব্যের ধনুক দিয়ে তীর ছুড়েছেন, সেই ঈমাম যুহরীও কিন্তু
হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সিদ্ধান্তকে ('তিনি নিজে ভিন্নমত পোষণ করা সত্ত্বেও') “বিদ’য়াত” বলেননি।

"তিনি বলেছেন— ‘হযরত উমর বিন আবদুল আযীয খলিফা হয়ে পূর্ববর্তী সুন্নত পুনর্বহাল করলেন। এখানে “পূর্ববর্তী সুন্নত” কথাটি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে,
হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরবর্তী সিদ্ধান্তটিও সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত।

"হযরত উমর বিন আবদুল আযীয খলীফা হয়ে পরবর্তী সুন্নতের স্থলে পূর্ববর্তী সুন্নত পুনর্বহাল করেছিলেন মাত্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়; মাওলানা মওদূদীর মতো
দায়িত্বশীল লেখক উপরোক্ত বাক্যের তরজমা করেছেন— “হযরত উমর বিন আবদুল আযীয খলীফা হয়ে এ “বিদ’য়াত” খতম করলেন। ” ('পৃঃ ১৭৩')
_
"এতবড় 'ভুল' কি কারো ইচ্ছার অগোচরে হতে পারে? শুধু বলতে চাই; আমরা মর্মাহত।
__________________________________________

"হযরত আলী (রাঃ)-কে গালমন্দ করা,,
_
"আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত শিরনামে' মওদূদী সাহেব বলছেন; আরো ঘৃণ্য একটি বিদ'আত মুয়াবিয়ার শাসনকালে শুরু হয়েছে। তিনি স্বয়ং এবং তার নির্দেশে সকল আঞ্চলিক প্রশাসক মসজিদের মিম্বরে বসে জুম'আর খোতবায় হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে গালমন্দের ঝড় বইয়ে দিতেন। এমনকি মসজিদে নববীতে রাসুল (সঃ)-এর মিম্বরে বসে রওজা শরিফ'কে সামনে রেখে তারই প্রিয়তম পাত্রকে গালিগালাজ করা হতো।
_
"এখানে মওদূদী সাহেব বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই আল্লাহর রাসুল (সঃ)-এর সাহাবীর বিরুদ্ধে তার কলমের কারিশমার দেখিয়েছেন। আমাদের কলম কিন্তু কথাগুলো এখানে উদ্ধৃত করতে দিয়ে লজ্জায় অনুশোচনায় বার বার থমকে যাচ্ছিলো। তবুও একান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমাদেরকে তা করতে হয়েছে।
_
"অভিযোগ প্রমাণের জন্য তিনি 'তাবাতী ও আল বিদায়া' গ্রন্থের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সবকটি বরাতগ্রন্থ ঘাটাঘাটি করে এরকম কোনো তথ্যের খোঁজ আমরা পাইনি।
_
"মওদূদী সাহেবের এই অসত্য ভাষণের লজ্জা থেকে বাঁচানোর কোনো উপায় আমাদের নাগালে আসেনি। এমনকি শীয়া ঐতিহাসিকদের বর্ণনাবলোতেও তাকে খুশী করার জন্য এমন কোন মশলা খোঁজে পাওয়া যায়নি।
_
"অতচ এধরণের কোনো ঘটনা আদৌ ঘটে থাকলে শীয়া ঐতিহাসিকরা যে ছেঁটে কথা বলবে'না সে-তো বলাই বাহুল্য। পক্ষান্তরে এমন অনেক বর্ণনা আমাদের দৃষ্টিপথে এসেছে, যাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে যে, তুমুল রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকা সত্ত্বেও হযরত আলী (রাঃ)-এর মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ছিলো সুগভীর শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা।
_
"নিম্নরূপ কয়েকটি উদাহরণঃ-
"জীবনের শেষ খোতবায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) ঘোষণা করেছিলেন; তোমরা দেখো, আমার পূর্ববর্তীগন যেমন আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন, তেমনি আমার পরবর্তী আমার চেয়ে উত্তম হবেন না। ('ইবনু আছিরকৃত আল কালিম ২'খণ্ড ৪'পৃষ্ঠা')
_
"হাফেজ ইবনে কাছীর বলেন- হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাতের খবর শুনে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন তাঁর স্ত্রী বললেন; আপনি কাঁদছেন কেন! অতচ তাঁর সাথে তোমার লড়াই ছিল। মুয়াবিয়া (রাঃ) বললেন; ঘোড়ামুখী! তুমি জানো'না মহত্ত্ব ফিক্বাহ ও ইলমের কী অমূল্য ধন মানুষ হারালো। ('আল বিদায়া ৮'খণ্ড ১৩০'পৃষ্ঠা')
_
"দেখুন- এখানে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর স্ত্রী লড়াইয়ের প্রসঙ্গ আনলেও একথা বলেননি যে, বেচে থাকতে তার বিরুদ্ধে গালমন্দের ঝড় বইয়ে দিতেন! আর এখন কান্নার ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন।
_
"ঈমাম আহমদ বলেন; হযরত বিছর বিন আরতাত (রাঃ) একবার হযরত মুয়াবিয়া ও হযরত যায়দ বিন উমর ইবনুল খাত্তাবের উপস্থিতিতেই হযরত আলীকে মন্দ বললেন। হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) তখন তাকে তিরস্কার করে বললেন; আলীকে তুমি গালমন্দ করছো, অতচ তিনি এর দাদা হন। ('তাবারী ৪'খণ্ড ২৪৮'পৃষ্ঠা- প্রকাশ কায়রো')
_
"হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর মজলিশে একবার হযরত আলীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হলে, তখন তিনি ('মুয়াবিয়া') বলেন; আবুল হাসান- হযরত আলীকে আল্লাহ রহম করুণ। সত্যিই তিনি এমন ছিলেন। ('ইসতী'আব ৩'খণ্ড ৪৩-৪৪'পৃষ্ঠা - প্রকাশ কায়রো')
_
"আল্লামা ইবনে আব্দুল বার (রহঃ).আরো চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন; ফিক্বাহ'সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সমাধান চেয়ে হযরত মুয়াবিয়া হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে পত্র যোগাযোগ করতেন। তাই তার সাহাদাতের খবর পেয়ে শোকাহত 'মুয়াবিয়া' (রাঃ) বলেন; আবু তালিব-পুত্রের মৃত্যুতে ইলম ও ফিক্বহের মৃত্যু হলো। ('ইসতী'আব ৪৫'পৃষ্ঠা')
_
"মোটকথা; ইতিহাস ও হাদিসশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলোতে এ-ধরনের অসংখ্য বর্ণনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মাওলানা মওদূদী সাহেবের তীক্ষ্ণ নজর ফাঁকি দিয়ে সেগুলো লুকিয়ে ছিলো, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আল্লাহ মালুম; কোন হৃদয়ে, কোন সাহসে একজন মজলুম সাহাবীর বিরুদ্ধে এমন মারমুখী ও খড়গহস্ত হতে পারলেন তিনি।
_
"আলী (রাঃ)-কে গালমন্দের অভিযোগে মওদূদী সাহেবের উদ্ধৃতিতে 'তাবারীর মূল ভাষ্য দেখে আসি। "হযরত মুগীরা উঠে দাঁড়ালেন এবং বরাবরের মতো এবারো 'আলী ও উসমান' সম্পর্কে বললেন; হে আল্লাহ! হযরত উসমান বিন আফফফান'কে রহম করুন, ক্ষমা করুন। তাঁর উত্তম কর্মের বিনিময় দান করুন। কেননা তিনি কোরান ও সুন্নাহ মুতাবেক আমল করতেন। এমনকি আমাদের রক্ত বাঁচাতে মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছেন। হে আল্লাহ! তাঁর সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী, অনুরক্ত এবং কিসাসের দাবী উত্থাপনকারীদের রহম করুন। অতঃপর তিনি হযরত উসমান হত্যাকারীদের নামে ববদু'আ করলেন। ('তাবাবী ৪'খণ্ড ১৮৮'পৃষ্ঠা')
_
"অতঃপর মওদূদী সাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন; সুতরাং দোষদুষ্ট বর্ণনাকারীদের যেসব রিওয়াতে ইবনে বার, আব্দুল বার, ইবনে জারীর, ইবনে কাছীর ও ইবনে হাজার প্রমুখ নির্ভরযোগ্য উলামা নিজ-নিজ গ্রন্থে গ্রহণ করেছেন, সেগুলোকে রদ করার যুক্তিসংগত কোনো কারন নেই। ('২১৭-১৯'পৃষ্ঠা')
_
"তাহলে আমাদের ছোঁট একটি প্রশ্নঃ- ইতিহাস'সংক্রান্ত বর্ণনার সনদগত চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পরিক্ষার প্রয়োজন যদি নাই থাকে, নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক'গণ প্রায় সকল বর্ণনার শুরুতে সদন যোগ করার খাটুনিটা কেন খাটলেন? এইসব ফালতু কাজটুকু না'করলেই কি হতোনা?
__________________________________________

"যিয়াদকে ভ্রাতৃমর্যাদা দান,,
_
"মাওলানা মওদূদী সাহেবের হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) ধর্মহীন রাজনীতি তথাকথিত যে পলিসি পবর্তন করেছিলেন! তার পঞ্চম প্রমাণ হলোঃ 'পিতৃপরিচয়হীন' যিয়াদ বিন সুনাইয়্যাকে ভ্রাতৃমর্যাদা দান।
_
"মওদূদী সাহেন বলেন; যিয়াদ বিন সুমাইয়্যাকে ভ্রাতৃমর্যাদা দানের মাধ্যমে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) রাজনৈতিক স্বার্থে শরীয়তের একটি সর্বস্বীকৃত বিধান লঙ্ঘন করেন।
_
"যে দুঃখজনক ভাষায় আলোচ্য ঘটনাটি মওদূদী সাহেব বিকৃত করেছেন, সে সম্পর্কে আমরা কোনো মন্তব্য করবো না। শুধু হৃদয় থেকে বেদনাময় রক্ত এবং চোখ থেকে অনুতাপের অশ্রু ঝরিয়ে প্রার্থনা করবো যে, মহান আল্লাহ যেনো তাঁর অবুঝ বান্দার কলমের কলঙ্ক মুছে দেন।
_
"এখানে আমরা মওদূদী সাহেবের দেয়া বরাতগ্রন্থের মূল উদ্ধৃতি তুলে ধরছিঃ- ইবনে খলদুন বলেন; যিয়াদের মা সুমাইয়্যা ছিলো হারিছ বিন কালদহর ক্রীতদাসী। তার ঐরসে সুমাইয়্যার গর্ভে হযরত আবু বাকরাহ (রঃ)-এর জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর সে তাকে নিজের আযাদকৃত গোলামের সাথে বিয়ে দেয়। সে সময় সুমাইয়্যার গর্ভে যিয়াদ জন্মগ্রহণ করেন। ('ঘটনা এই যে') কোন কার্যোপলক্ষ্যে আবু সুফিয়ান একবার তায়েফ গেলেন। সেখানে জাহেলিয়াতের কোন এক বিবাহ পদ্ধতিতে সুমাইয়্যার সাথে মিলিত হলেন। পরে সুফিয়ানের জন্ম হলে সুমাইয়্যা তাকে আবু সুফিয়ানের ঐরসজাত বলে ঘোষণা করেন এবং আবু সুফিয়ান গোপনীয়তা রক্ষার্থে তা স্বীকার করে নেন। (৩'খণ্ড ১৪'পৃষ্ঠা')
_
"ইবনে খালদুন আরো লিখেন; হযরত আলীর শাহাদাতের পর যিয়াদ হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর সাথে সমঝোতায় উপনীত হন। যিয়াদের নির্দেশে মুছকালা বিন হোবায়রা তখন মুয়াবিয়াকে যিয়াদের ঘটনা আদ্যোপান্ত অবহিত করেন। ('সব ঘটনা শুনে') যিয়াদকে তিনি নসবের স্বীকৃতি প্রধানের মাধ্যমে আনুগত্য করার সিদ্ধান্ত নেন। (৩'খণ্ড ৩৫'পৃষ্ঠা')
_
"ইবনুল কাছীর বলেন; জাহেলিয়াতের যুগে কয়েক পদ্ধতিতে বিবাহ প্রথা চালু ছিল। যেমন- এক নারীর সাথে একাধিক পুরুষ মিলিত হতো, প্রসবের পর 'মা' সন্তানকে যার ঐরসজাত বলে ঘোষণা দিতো, সে তার সন্তান বলেই স্বীকৃতি লাভ করতো। ইসলাম পরবর্তীতে এ-ধরণের বিবাহ-প্রথা হারাম বলে ঘোষণা করলেও জাহেলী যুগের প্রচলিত বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সকল নসবই ইসলাম বৈধ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। নসবের ব্যাপারে উভয় যুগের বিবাহে কোন পার্থক্য করেননি। ('আল কালিম ৩'খণ্ড ১৭৬'পৃষ্ঠা')
_
"সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস- হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন; ৪৪'হিজরীতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যিয়াদকে ঐরসভুক্তি অনুমোদন করেন। আর যিয়াদের পক্ষে দশজন ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ('তারপর সাক্ষীদের নাম উল্লেখ করে, ইবনে হাজার বলেন') মুনযির বিন যোবায়ের তার সাক্ষ্যে বলেন; আমি নিজে হযরত আলীকে বলতে শুনেছি যে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আবু সুফিয়ান এধরণের কথা বলেছিলেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনার পর এক খোতবায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যিয়াদকে ঐরসভুক্তি অনুমোদন করলেন। যিয়াদ তখন ('নিজের প্রতিক্রিয়া প্রশংসা করে') বললেন; এরা যা বলছে, তা সত্য হলে আলহামদুলিল্লাহ! আর মিথ্যা হলে আমার ও আল্লাহর মাঝে এদেরকে আমি জিম্মাদার বানালাম। ('আল ইছবাহ ১'খণ্ড ১৬৩'পৃষ্ঠা')
_
"ইতিহাসের পাতায় পাতায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর এ তেজোদ্দীপ্ত শপথ ঘোষণা দেয়ার পরও কোন হৃদয়ে মওদূদী সাহেব বললেন; যিয়াদ বিন সুমাইয়্যার ঐরসভুক্তি অনুমোদনের বেলায়ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) রাজনৈতিক স্বার্থে শরীয়তের এক স্বীকৃত বিধান লঙ্ঘন করেছেন। মুহূর্তের জন্যও তার হৃদয় কেঁপে উঠলো না, কলম থমকে গেলো না!
_
"পরবর্তীকালে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সমালোচকদের অনেকেই হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর খিদমতে হাজির হয়ে লজ্জা ও অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। আর ধৈর্য ও সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হাসিমুখে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ('আল ইসতী'আব ১'খণ্ড ৫৫১-৫৫ এবং তাবারী ৪'খণ্ড ১৬৩'পৃষ্ঠা')
_
"আশ্চর্য! তের'শ বছর পর এক পণ্ডিত-গবেষকের কলমের এক খোঁচায় যিয়াদ বিন সুমাইয়্যাকে হারামজাদা বানিয়ে ছাড়লেন। অতচ হযরত মুয়াবিয়ার সমসাময়িক সমালোচকদের একজনও এ সে কথা বলেন'নি। বরং তাদের সবার বক্তব্য এই ছিল যে, দাসী সুমাইয়্যার সাথে হযরত আবু সুফিয়ানের সহবাসই হয়নি।
__________________________________________

"এবার আসুন আমরা দেখে আসি 'সাহাবীদের দৃষ্টিতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কিরকম ছিলেন।

"হযরত উমর (রাঃ) বলেন; হে লোক'সকল! আমার মৃত্যুর পর দলাদলি ও কোন্দল এড়িয়ে চলবে। যদি তা না'করো, তবে মনে রেখো; সিরিয়ায় কিন্তু 'মুয়াবিয়া' রয়েছে। সে তোমাদের অবশ্যই শায়েস্তা করবে। ('আল ইছবাহ ৩'খণ্ড ৪১৪'পৃষ্ঠা')
_
"আল্লামা ইবনে হাজার বলেন; সিফফিনের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আপন অনুগামীদের লক্ষ্য করে হযরত আলী (রাঃ) বলেছিলেন; হে লোক সকল! মুয়াবিয়ার শাসনকে তোমরা না-পছন্দ করো না। কেননা তাকে যেদিন হারাবে সেদিন দেখবে, ধড় তেকে মুণ্ডুগুলো হানযাল ফলের মতো কেটে কেটে পড়ে যাচ্ছে। ('আল বিদায়া ৮'খণ্ড ১৩১'পৃষ্ঠা')
_
"যারা আমার সাহাবা ও আহেল বাইত'কে গালমন্দ করে, তাদের প্রতি আল্লহর অভিশাপ। ('আল বিদায়া ৮'খণ্ড ১৩৯'পৃষ্ঠা')
_
_"বিঃদ্রঃ- হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) ছিলেন; খুবী স্মিত ও স্নিগ্ধ স্বভাবের অধিকারী। যেকোনো সাধারণ লোকও নির্ভয়ে তার সাথে কথা বলতো এবং আবদার-অভিযোগ পেশ করতো। সম্ভব হলে তিনি সেগুলো পূরণ করে দিতেন, আর সম্ভব না'হলে খুবী কুমলভাবে এড়িয়ে যেতেন।

"একবার উনাকে প্রশ্ন করা হলো যে, আপনি খুব দ্রুত বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন! উত্তরে তিনি বলেন; কেন নয়? আমার অবস্থা এই যে, মূর্খের দল একের পর এক ভিত্তিহীন অপবাদ আরোপ করছে। সন্তোষজনক জবাব দিলেও কেউ তাতে কর্ণপাত করে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে কখনো কোন ভুল করে বসলে, মুহূর্তে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ('আল বিদায়া ৮'খণ্ড ১৪১'পৃষ্ঠা')

"এরকম একজন সাহাবীকে আমরা গালমন্দ করতেও আমাদের দ্বিধাবোধ করেনা। মুহূর্তের জন্য একবার চিন্তাও করিনা যে, রাসুল (সঃ)-এর সাহাবীর গালি কালি লেপন দিচ্ছি। তার পরিণাম কি ভয়াবহ হবে??

"মহাম আল্লাহ যেনো আমাদের এইসব চরমপন্থিদের তেকে দূরে রাখেন। আমীন।
_
"লেখাটি কপি-শেয়ার বা ম্যানশন করে দ্বীনি ভাইদের কাছে ছড়িয়ে দিন,, জাযাকাল্লাহ খাইরান।.....✍🏻

Post a Comment

0 Comments