Subscribe Us

হে পথিক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই ,আসোল ভবিষ্যৎ হলো পরোকাল

দুনিয়ার ধোঁকায় পড়বেন না; দুনিয়ার হাকিকত: 02


দুনিয়ার ধোঁকায় পড়বেন না; দুনিয়ার হাকিকত: ০২ 

এরপর আল্লাহ পার্থিব জীবনের একটি উপমা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, দুনিয়ার জীবন হল সাময়িক চাকচিক্য, ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য ও ধ্বংসশীল নেয়ামত। 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও অনিশ্চয়তার উপমা প্রদান করে ইরশাদ করেছেন-

كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَريهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا

যেমন, এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে আপনি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পান, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়।

 [সূরা হাদীদ: ২০] 

অর্থাৎ সেই বৃষ্টির মতো, যার অপেক্ষা করতে করতে এক সময় মানুষ নিরাশ হয়ে যায়, অতঃপর হঠাৎই এক সময় বৃষ্টি এসে পড়ে।

যেমন, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন—

وَ هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ الْغَيْثَ مِنْ بَعْدِ مَا قَنَطُوا

মানুষ নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। [সূরা শূরা : ২৮]

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বাণী-... ‘যার সবুজ ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করে।' 

অর্থাৎ বৃষ্টি দ্বারা উৎপন্ন ফসল যেমন কৃষকদের চমৎকৃত করে, তেমনি দুনিয়ার এ জীবন ও তার ক্ষণস্থায়ী আনন্দ- উপভোগ কাফেরদের আনন্দিত ও খুশি করে। 

তারা কেবল দুনিয়া নিয়েই মেতে থাকে। কারণ, তারা দুনিয়ার প্রতি সর্বাধিক আসক্ত ও লোভী। মানুষের মধ্যে তারাই দুনিয়ার প্রতি সবচেয়ে বেশি ধাবিত। 

অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন-

ثُمَّ يَهِيجُ فَتَريهُ مُصْفَراثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا

‘এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে আপনি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পান, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়।' অর্থাৎ যে ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করেছিল, তা এক সময় শুকিয়ে যায়। তখন আপনি সেগুলোকে পীতবর্ণের দেখতে পান। অথচ কিছু সময় পূর্বেও এগুলো সবুজ-শ্যামল ও তরতাজা ছিল। 

এরপর এ সবগুলোই খড়কুটোয় পরিণত হয়। অর্থাৎ একদম শুকনো খড়কুটোয় পরিণত হয়ে যায়। এ-ই হচ্ছে দুনিয়ার উপমা। প্রথমে দুনিয়া থাকে তরতাজা ও যুবক। তারপর ধীরে ধীরে তা দুর্বল হতে থাকে। এক সময় সে অতিশয় দুর্বল ও বৃদ্ধ হয়ে যায়।

মানুষও ঠিক তেমনই। মানুষের জীবনের শুরুটা থাকে তরতাজা ও প্রাণচঞ্চল। তারপর আসে টগবগে যৌবন। সুন্দর সুদর্শন ও দৃষ্টিনন্দন। তারপর এক সময় ধীরে ধীরে সে দুর্বল হতে শুরু করে। 

তার শক্তি- সামর্থ্য ও রঙ পরিবর্তন হতে থাকে। হতে হতে এক সময় সে শরীরের কিছু শক্তি হারিয়ে ফেলে। 

তারপর বৃদ্ধ হতে থাকে। এক পর্যায়ে সে শীর্ণ, ক্ষীণকায় ও অতিশয় দুর্বল বৃদ্ধে পরিণত হয়। তার শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। নড়াচড়াও করতে পারে না। স্বল্প জিনিসই তাকে দুর্বল, কাহিল ও অক্ষম করে 

দেয়। 


দুনিয়ার হাকিকত

যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন—

اللهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ ضُعَفَ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ ضُعَفَ قُوَّةٌ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ ضُعَفَا وَ شَيْبَةٌ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ وَهُوَ الْعَلِيمُ الْقَدِيرُ

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা, যিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন, অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তিদান করেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। 

[সূরা রূম : ৫৪]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রথমে এই উপমার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, এই দুনিয়া ও তার যাবতীয় নেয়ামত নশ্বর ও ধ্বংসশীল। দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়, এখানে কেউ চিরদিন থাকবে না। অবশ্যই একদিন না একদিন সকলকে এখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে।

পক্ষান্তরে আখেরাতের কোনো শেষ নেই। আখেরাত স্থায়ী। তার জীবন অনন্ত, নেয়ামত অফুরন্ত। 

আখেরাতের জীবন কখনও শেষ হবে না। তাই তিনি আমাদের দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে নিষেধ করেছেন। বরং আখেরাতমুখী হতে বলেছেন এবং আখেরাতের কল্যাণ অর্জনে উৎসাহিত করেছেন।

এই মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وَ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَ مَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ، وَمَا الْحَيُوةُ الدُّنْيَا إِلَّا

مَتَاعُ الْغُرُورِ

আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়। 

[সূরা হাদীদ : ২০]

অর্থাৎ অবশ্যম্ভাবীরূপে আগত আখেরাতের এ দু'টি ব্যতীত আর কোনো বিষয় থাকবে না। হয়তো এটি, নয়তো সেটি। হয়তো মর্মন্তুদ শাস্তি, নয়তো মহান রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বাণী-'পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।' অর্থাৎ এই দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী


ও ধ্বংসশীল এবং এর প্রতি ধাবিতদের জন্য এক ধোঁকার উপকরণ। কেননা, তারা এ দুনিয়া নিয়ে ধোঁকায় লিপ্ত এবং দুনিয়া নিয়েই তারা মত্ত ও সন্তুষ্ট। এমনকি তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই দুনিয়া ছাড়া আর কোনো জীবন নেই; এর আড়ালে কোনো প্রত্যাবর্তনস্থল নেই। অথচ আখেরাত ও আখেরাতের স্থায়ী জীবনের তুলনায় দুনিয়া ও দুনিয়ার জীবন খুবই নগণ্য ও তুচ্ছ। যাদের মাঝে কখনও তুলনা করা চলে না।

[তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৮/২৪]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন -

وَاضْرِبْ لَهُمْ مَّثَلَ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا كَمَاء انْزَلْنَهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ

الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذَرُوهُ الرِّيحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُّقْتَدِرًا

তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আর আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। 

[সূরা কাহফ : ৪৫]

আয়াতের ব্যাখ্যায় তবারী বলেন, সম্পদশালীরা যেন তাদের সম্পদের আধিক্যের কারণে অহংকার না করে। অন্যদের উপর যেন বড়াই না করে। দুনিয়াদাররা যেন তাদের দুনিয়া নিয়ে ধোঁকায় লিপ্ত ও প্রবঞ্চিত না হয়। কেননা, দুনিয়ার উপমা হচ্ছে এইসব ফসলের ন্যায়, যা বৃষ্টির কারণে সুজলা-সুফলা, সবুজ-শ্যামল ও দৃষ্টিনন্দন হয়। কিন্তু যখনই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, তখন তা শুকিয়ে যায়। তখন আর তার সেই সজীবতা ও সৌন্দর্য অবশিষ্ট থাকে না। 

বরং তা পরিণত হয়ে যায় শুষ্ক খড়-কুটোয়। বাতাস যাকে উড়িয়ে এদিক-সেদিক নিয়ে যায় তখন আর মানুষের দৃষ্টিও সেগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয় না। দুনিয়ার জীবনও ঠিক এসব ফসলের মতো। অতএব, যে জীবনের বাস্তবতা, ফলাফল ও পরিণতি এমন, সে জীবনের জন্য ব্যস্ত না হয়ে আমাদের এমন এক জীবনের জন্য কাজ করা উচিত, যা চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। যা কোনোদিন পরিবর্তন, বিবর্ণ ও বৃদ্ধ হবে না। 

[তাফসীরে তবারী : ১৮/৩০]


ইবনে কাসীর বলেন, আল্লাহ সম্বোধন করে ইরশাদ করেন, তাঁর প্রিয় হাবীব কে হে নবী! আপনি মানুষের জন্য পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও বিলুপ্তির উপমা বর্ণনা করুন। পার্থিব জীবন তো হল সেই পানির মতো, যা আমি আকাশ থেকে অবতীর্ণ করেছি। 

অতঃপর সেই পানির সাথে ভূমির বীজ মিশ্রিত হয়ে চারা গজিয়েছে এবং তা থেকে সবুজ-শ্যামল লতা-পাতা উৎপন্ন হয়েছে। অতঃপর শুষ্ক হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে; যা ডানে-বামে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আর আল্লাহ সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি শ্যামল- সবুজও করতে পারেন আবার তাকে শুষ্ক করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বিলুপ্তও করে দিতে পারেন। আল্লাহ বহু স্থানে পার্থিব জীবনকে এই উপমা দ্বারা বর্ণনা করেছেন। 

[তাফসীরে ইবনে কাসীর : ৫/১৬১]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন-

 إِنَّمَا مَثَلُ الْحَياةِ الدُّنْيَا كَمَاء انْزَلْنَهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِنَا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَدِرُونَ عَلَيْهَا أَنْهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَهَا حَصِيْدًا كَأَنْ لَّمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الْأَيْتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

পার্থিব জীবনের উদাহরণ তেমনি, যেমনি আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করলাম, পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে জামিনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এল, যা মানুষ ও জীব-জন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি জমিন যখন সৌন্দর্য-সুষমায় ভরে উঠল আর জমিনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে, হঠাৎ করে তার উপর আমার নির্দেশ এল রাতে কিংবা দিনে, তখন সেগুলোকে কেটে স্তূপাকার করে দিল যেন গতকালও এখানে কোনো আবাদ ছিল না। এমনিভাবে আমি খোলাখুলি বর্ণনা করে থাকি নিদর্শনসমূহ, সে সমস্ত লোকের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে। 

[সূরা ইউনুস : ২৪]

ইবনুল কায়্যিম বলেন, আল্লাহ দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ বর্ণনা করার জন্য একটি উপমা দিয়ে বলেন যে, দুনিয়ার জীবন একজন পরিদর্শকের দৃষ্টিতে খুবই সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন। সে এর সৌন্দর্য-শোভা.

দেখে বিস্মিত হয়, মুগ্ধ হয়। অতঃপর সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং প্রবঞ্চিত হয়ে দুনিয়াকেই কামনা করে। এমনকি এক পর্যায়ে সে ভাবতে থাকে, এ জীবনের মালিক সে নিজেই এবং সে একে ধরে রাখতে সক্ষম। এরপর হঠাৎই তার থেকে তার জীবনকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যে জীবনের প্রতি সে খুব বেশি আকৃষ্ট ও নির্ভরশীল ছিল। তার মাঝে ও তার জীবনের মাঝে এক মহাপ্রাচীর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ দুনিয়ার এ জীবনের উপমা দিয়েছেন ওই ভূমির সাথে, যাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। অতঃপর তা উর্বর হয়ে উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। 

ফসলের সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। এই দৃশ্য দর্শকের অন্তরে আনন্দের ঢেউ তোলে এবং সে মনে করতে থাকে, সে নিজেই ফসল উৎপন্ন করতে সক্ষম এবং সে নিজেই এর মালিক। অতঃপর হঠাৎই তাতে আল্লাহর আদেশ চলে আসে এবং আক্রান্ত হয় ফসলের জমি। ফলে তা এমন হয়ে যায়, যেন গতকালও এখানে কোনো ফসলি জমি ছিল না। 

তখন তার ধারণা ও বিশ্বাস একেবারেই পাল্টে যায় এবং সে একদম নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত হয়ে যায়। দুনিয়ার জীবনের অবস্থা এবং যারা দুনিয়ার জীবনকে আঁকড়ে থাকে, তাদের অবস্থা এমনই। এ দৃষ্টান্ত দুনিয়ার জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। 

[ই'লামুল মুওয়াক্কিয়ীন : ১/১৫৩]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন—

وَمَا هُذِهِ الْحَيُوةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهُوٌ وَ لَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বৈ তো কিছুই নয়। পরকালের গৃহই তো প্রকৃত জীবন; যদি তারা জানত।

[সূরা আনকাবূত : ৬৪] 

আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম ইরশাদ করেছেন—

إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النَّسَاءِ . وفي رواية لِيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُوْنَ.

 


নিশ্চয় দুনিয়া মিষ্টি সবুজ [সুস্বাদু, দর্শনীয়]। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেখানে তোমাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। তিনি দেখতে চান, তোমরা কী কর! অতএব, দুনিয়া ও নারী থেকে তোমরা সাবধান থেকো। কেননা, বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রথম যে ফেতনা দেখা দিয়েছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, যাতে তিনি দেখেন তোমরা কেমন আমল কর। 

[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৪২, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১১১৬৯]

 

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাঃ থেকে বর্ণিত —, 

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন

الدُّنْيَا مَتَاعُ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ.

দুনিয়া উপভোগের উপকরণ, আর দুনিয়ার উত্তম উপভোগ্য উপকরণ পুণ্যবতী নারী। 

[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৭১৬, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৩২৩২, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৬৫৬৭]

 

সাহল ইবনে সা'দ আস-সায়িদী থেকে রাঃ  বর্ণিত, তিনি বলেন,

নবীজি সাঃ ইরশাদ করেছেন-

لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوضَةٍ مَا سَقَى كَافِرًا مِنْهَا شَرْبَةَ

আল্লাহর নিকট যদি এই পৃথিবীর মূল্য মশার একটি পাখার সমানও হত, তা হলে তিনি কোনো কাফেরকে এখানকার পানির একটি ঢোঁকও পান করাতেন না।

 [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৩২০, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৭৭]


 আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

مَرَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشَاةٍ مَيْتَةٍ قَدْ أَلْقَاهَا أَهْلُهَا فَقَالَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ عَلَى أَهْلِهَا.

একদিন রাসূলুল্লাহ এর একটি মৃত বকরির পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে বকরিটিকে তার মালিক [রাস্তায়] ফেলে দিয়েছিল। তখন তিনি বললেন, যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ!


নিশ্চয় এই মৃত বকরিটি তার মালিকের কাছে যতটা মূল্যহীন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া তার চেয়েও অধিক মূল্যহীন। 

[মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৩০৪৭]

আমাদের কেউ যদি দুনিয়ার প্রকৃত বাস্তবতা নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখে, তা হলে সে অবশ্যই এই দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় কিছুকে অত্যন্ত নগণ্য ও তুচ্ছ পাবে; যার জন্য এত কষ্ট করা এবং যার পিছনে ছুটে চলার কোনো অর্থ হয় না। 


যেমন, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাঃ। সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِالسُّوقِ دَاخِلاً مِنْ بَعْضِ الْعَالِيَةِ وَالنَّاسُ كَنَفَتَهُ فَمَرَّ بِجَدِي أَسَكَ مَيِّتٍ فَتَنَاوَلَهُ فَأَخَذَ بِأُذُنِهِ ثُمَّ قَالَ أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنَّ هَذَا لَهُ بِدِرْهَمٍ ؟ فَقَالُوا مَا تُحِبُّ أَنَّهُ لَنَا بِشَيْءٍ وَمَا نَصْنَعُ بهِ : قَالَ أَتُحِبُّونَ أَنَّهُ لَكُمْ ؟ قَالُوا وَاللهِ لَوْ كَانَ حَيًّا كَانَ عَيْبًا فِيهِ لأَنَّهُ أَسَكُ فَكَيْفَ وَهُوَ مَيِّتُ : فَقَالَ فَوَاللهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللَّهِ مِنْ هَذَا

একদিন রাসূলুল্লাহ ‘আলিয়া’ অঞ্চল থেকে মদীনায় আসার পথে বাজার দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ উভয় পাশে বেশ লোকজন ছিল। যেতে যেতে তিনি ক্ষুদ্র কান বিশিষ্ট একটি মৃত বকরির বাচ্চার কাছে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি তার কান ধরে বললেন, তোমাদের কেউ কি এক দিরহাম দিয়ে এটা কিনতে আগ্রহী? তখন উপস্থিত লোকেরা বললেন, কোনো কিছুরই বিনিময়ে এটা আমরা নিতে আগ্রহী নই; আর এটা নিয়ে আমরা কী করব?! 

তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, [বিনা পয়সায়] তোমরা কি তা নিতে আগ্রহী? তারা বললেন, এ যদি জীবিত হত তবুও তো এটা দোষী। কেননা, এর কানগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। আর এখন তো এটা মৃত! আমরা কীভাবে এটা গ্রহণ করব? তখন নবীজি ইরশাদ করলেন, আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটা মূল্যহীন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া এর চেয়ে আরও বেশি মূল্যহীন। 

[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৫৭]


আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি এ ইরশাদ করেছেন-

الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِن وَجَنَّةُ الْكَافِرِ.

দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফেরের জন্য জান্নাততুল্য।

 [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬০৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪১১৩, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৩২৪]

মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ এ ইরশাদ করেছেন—

والله ما الدُّنْيَا فِي الآخِرَةِ إِلا مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ هَذِهِ -

وَأَشَارَ يَحْتِي بِالسَّبَّابَةِ - فِي الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ.

আল্লাহর কসম! দুনিয়ার জীবন আখেরাতের জীবনের তুলনায় এমন, যেমন তোমাদের কেউ তার এ আঙুলটি বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া শাহাদাত আঙুল দ্বারা ইশারা করলেন— সমুদ্রের পানিতে ভেজাল। অতঃপর সে দেখুক কতটুকু পরিমাণ [পানি] এতে লেগেছে। 

[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৭৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪১০৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৮০০৮] 

এ দুনিয়ার কোনো নেয়ামত এ পর্যায়ের নয়, যা পেলে আনন্দিত হওয়া যায় কিংবা হাতছাড়া হয়ে গেলে পেরেশান হতে হয়।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- যে ব্যক্তির কাছে এক হাজার দিনার আছে, সে কি ‘যাহেদ' [দুনিয়াবিমুখ ও দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত] হতে পারে? তিনি জওয়াব দিয়েছিলেন— হাঁ, যদি সে ওই পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটলে আনন্দিত না হয় এবং হ্রাস পেলে দুঃখিতও না হয়। 

[মাদারিজুস সালিকীন : ১/৪৬৫, ফয়যুল কদীর : ৪/৭২]

 মিহসান আল-আনসারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন—

مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِي سِرْبِهِ مُعَافِّى فِي جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوْتُ يَوْمِهِ

فَكَأَنَّمَا حِيْزَتْ لَهُ الدُّنْيَا.

দুনিয়ার মোহে পড়বেন না

তোমাদের মধ্যে যে লোক পরিবার-পরিজনসহ সকালে উপনীত হয়, শরীর সুস্থ থাকে এবং তার কাছে এক দিনের খোরাক থাকে, তা হলে যেন তার জন্য গোটা দুনিয়াটাই একত্র করা হল। [সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৩৪৬]

 

অতএব, মানুষের উচিত, দুনিয়া ও দুনিয়ার উপার্জনকে মানসিক প্রশস্ততা ও উদারতার সাথে গ্রহণ করা। একদিকে যেমন সম্পদ উপার্জন করবে, অন্যদিকে এ সম্পদ একজনকে হাদিয়া দিবে, আরেকজনকে সাহায্য করবে, অপরজনকে দান করবে। এভাবে কেমন যেন মানুষের সম্পদই তার কাছে গচ্ছিত রয়েছে।।।

 দুনিয়ার মোহে পড়বেন না, দুনিয়ার হাকিকত: ০২ 

Post a Comment

0 Comments