রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তৃতার ধরণ কেমন ছিলো? সুর দিয়ে ওয়াজ করার বিধান কী?
প্রশ্ন: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়াজ বা বক্তৃতার
ধরণ কী? সুর দিয়ে ওয়াজ বা ইসলামি আলোচনা করা কতটা বৈধ?
উত্তর:
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাধারণতঃ বক্তব্যের
ধরণ ছিল, তিনি সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বক্তব্য দিতেন। মনে হতো, তিনি সেনাবাহিনীকে
সতর্ক করছেন। এতে তার গলার রগগুলো ফুলে উঠত, আওয়াজ উঁচু হতো ও চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে
যেত। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত,
كانَ رَسولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عليه وَسَلَّمَ إذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ، وَعَلَا صَوْتُهُ، وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ، حتَّى كَأنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ
“যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ভাষণ দিতেন, তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত এবং তাঁর আওয়াজ উঁচু হত ও তাঁর ক্রোধ কঠিন
রূপ ধারণ করত। যেন তিনি (শত্রু) সেনা থেকে ভীতি প্রদর্শন করছেন।”
[সহিহ মুসলিম, হা/৮৬৭,১৮৯০,১৮৮৩,১৮৭৫]
এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, এটা বক্তৃতার বিষয় এবং শ্রোতাদের
অবস্থার উপর নির্ভরশীল হতো। যদি তিনি এমন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন যখন মানুষকে সতর্ক করার
প্রয়োজন হতো অথবা শ্রোতাদের মধ্যে কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারতেন যে, সে আল্লাহ
ও রসুলের অবাধ্যতা করেছে বা আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করেছে তখন তার বক্তৃতার ধরণ এমন হতো।
আবার কখনো তিনি নরম
ভাষায় অন্তর বিগলিত করার মত বক্তব্য দিতেন। এতে শ্রোতাদের দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে
পড়ত। যেমন:
◈ ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি
বলেন,
وعَظَنَا رسولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- مَوْعِظَةً وجِلَتْ منها القلوبُ، وذَرَفَتْ منها العيونُ ، قال : فقلْنَا : يا رسولَ اللهِ، كأَنَّ هذه مَوْعِظَةُ مُودِّعٍ
“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনভাবে
ওয়াজ করলেন যাতে আমাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়লো ও আমাদের চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হয়ে গেলো।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল, এটা মনে হচ্ছে, শেষ বিদায়ের উপদেশ বার্তা। তাই আপনি আমাদেরকে
ওসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) দান করুন...।”
[আবু
দাউদ(৪৬০৭) ও তিরমিজি, (২৬৬) হাদিসটি বর্ণনা করার পর বলেছেন যে, এটা সহিহ (হাসান)।]
তিনি তাড়াহুড়ো করে বা অতিরিক্ত টেনে লম্বা করে, সুর দিয়ে
হেলে দুলে বক্তব্য দিতেন না। এগুলো তার আদর্শ পরিপন্থী কাজ।
◈ মা-জননী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَكُنْ يَسْرُدُ الْحَدِيثَ كَسَرْدِكُمْ
“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মত দ্রুত
কথা বলতেন না (বরং তিনি ধীর স্থির ও স্পষ্টভাবে কথা বলতেন।”
[সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫০/
আম্বিয়া কিরাম আ., পরিচ্ছেদ: ২০৭৩. নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবরণ]
◈তিনি
(আয়েশা রা.) আরও বলেন,
كَانَ يُحَدِّثُ حَدِيثًا لَوْ عَدَّهُ الْعَادُّ لَأَحْصَاهُ
“তিনি এমন ভঙ্গিমায় কথা বলতেন, যদি গণনাকারী চাইত তাহলে তা গণনা
করতে পারত।”
[বুখারীঃ ৩৫৬৭-৬৮,৩৩১২; মুসলিম ৭৭০১]
◆ ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
المراد بذلك المبالغة في الترتيل والتفهيم
“এর অর্থ হলো, সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং বোঝানোর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া।”
অর্থাৎ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া কথা বলার ক্ষেত্রে ধীর স্থিরতা অবলম্বন
করতেন এবং প্রতিটি শব্দকে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণের ক্ষেত্রে জোর দিতেন।
তাই ওয়াজ, খুতবা বা বক্তৃতার ক্ষেত্রে গান বা কবিতার মতো করে
সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। কারণ তা শ্রেষ্ঠ আদর্শ মানব প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ পরিপন্থী। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এসব শ্রুতি মধুর ও
আকর্ষণীয় বক্তৃতা তৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে শ্রবণ করে থাকে; হেদায়েত বা উপদেশ গ্রহণের
উদ্দেশ্যে নয়। তাছাড়া এ ধরনের বক্তার মনে
মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনের মনোভাব বা রিয়া সৃষ্টি করতে
পারে। যা বক্তার আমল বিনষ্ট করার পাশাপাশি দাওয়াতের এ মর্যাদাপূর্ণ অঙ্গনকে কুলুষিত
করে।
◆ মিসরের সিনিয়র স্কলার শাইখ আলী মাহফুজ বলেন [মৃত্যু:
১৯৪২]
الترنم في الخطيب من البدع المحدثة
"বক্তাদের সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া নব আবিষ্কৃত বিদআতের
অন্তর্ভুক্ত।" [আল ইবদা ফি মাযাররিল ইবতিদা, পৃষ্ঠা নম্বর ৪৫]
◆ অনুরূপভাবে শাইখ বকর আবু জায়েদ একই কথা বলেছেন।
[তাসহীহুদ দুআ, পৃষ্ঠা নম্বর: ৪৫৫]
এছাড়াও ইমাম ইবনুল জাওযি সুর করে বক্তব্য দেওয়াকে মুনকার বা
গর্হিত কাজ হিসেবে এবং মোহাম্মদ রশিদ রেজা এটিকে মাকরুহ বা অ পছন্দনীয় কাজ হিসেবে
উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে আরও বিভিন্ন ওলামাদের বক্তব্য রয়েছে।
✪ ইবনুল জাওযি-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
তিনি বলেন,
تأملت أشياء تجري في مجالس الوعظ ، يعتقدها العوام وجهال العلماء قربة ، وهي منكر وبعد . وذاك أن المقرئ يطرب ويخرج الألحان إلى الغناء ، والوعظ ينشد بتطريب أشعار المجنون وليلى ، فيصفق هذا ، ويخرق ثوبه هذا .. ومعلوم أن هذه الألحان كالموسيقى ، توجب طرباً للنفوس ونشوة ، والتعرض لما يوجب الفساد غلط عظيم .. ألا إن الواعظ مأمور بأن لا يتعدى الصواب ، ولا يتعرض لما يفسدهم
"আমি লক্ষ্য করেছি যে, অনেক ওয়াজ মাহফিলে এমন কিছু ঘটনা
ঘটে যাকে সাধারণ মানুষ এবং স্বল্প জ্ঞানী বিদ্বানরা ভুল করে আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের
উপায় মনে করে। কিন্তু আসলে তা গর্হিত কাজ এবং আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরের বিষয়। যেমন:
কুরআন তিলাওয়াত কারী গানের মতো সুরে তিলাওয়াত করে এবং বক্তা লায়লা-মজনুর মতো প্রেমিক
কবিদের কবিতা গাইতে গাইতে উপদেশ দেন। কেউ হাত তালি দেয়। কেউ আবার নিজের জামা-কাপড় ছিঁড়ে
ফেলে। এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের সুর ও গান মিউজিকের মত মনের মধ্যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস
সৃষ্টি করে। অথচ এমন কিছু করা যা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে তা বিশাল ভুল। স্মরণ রাখতে
হবে যে, একজন বক্তা বা উপদেশ দাতার কাজ হল, নিজে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং
এমন কিছু না করা যা মানুষকে ভ্রষ্ট করে দেয়।" [সাইদুল খাতের, পৃষ্ঠা নং ১০৭]
অবশ্য বক্তব্যের মধ্যে কুরআনের আয়াতের অংশটুকু সুর করে তেলাওয়াত করতে কোন আপত্তি নেই। কেননা হাদিসে সুর করে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে :
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
0 Comments