►আরাফার দিনের রোযা: একটি বিস্তারিত আলোচনা:
✎সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর।
আরাফার দিনের রোযা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ ইবাদত। এই দিনের রোযার ফজিলত এবং এর বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন মাযহাবের মতামত নিচে আলোচনা করা হলো:
✎১.
যারা হাজী নন তাদের জন্য আরাফার দিনের রোযা:
যারা হজ পালন করছেন না, তাদের জন্য আরাফার দিনের রোযা রাখা সুন্নতে মুয়াক্কাদা (তাগিদপূর্ণ সুন্নত)। এটি বিগত ও আগত বছরের পাপ মোচনের একটি মহৎ সুযোগ।
https://www.hadithbd.com/hadith/detail/chapter/?book=22&chapter=18211
✎হাদিসের প্রমাণ:
আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরাফার দিনের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: "বিগত ও আগত বছরের পাপ মোচন করে।" (সহিহ মুসলিম: ১১৬২) সহিহ মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে: "আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করছি যে, আগের বছরের ও পরের বছরের গুনাহ মোচন করবে।"
✎ইমাম শাফেয়ি (রহঃ)-এর অভিমত:
ইমাম নববী (রহঃ) তাঁর 'আল-মাজমু' গ্রন্থে (৬/৪২৮) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম শাফেয়ি ও তাঁর ছাত্ররা বলেছেন:
"যারা আরাফায় নেই তাদের জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব।"
✎পক্ষান্তরে, হজ্জপালনকারী যিনি আরাফার ময়দানে হাজির তার ব্যাপারে মুখতাসার গ্রন্থে রয়েছে ইমাম শাফেয়ি ও মাযহাবের অন্য আলেমগণ বলেন: উম্মে ফযল এর হাদিসের ভিত্তিতে তার জন্য সেদিন রোযা না-রাখা মুস্তাহাব। আমাদের অন্য একদল আলেম বলেন: হজ্জপালনকারীর জন্য এই দিন রোযা রাখা মাকরুহ।
যারা এ অভিমত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন তারা হচ্ছে- দারেমী, বন্দানিজি, মুহামিলি ‘আল-মাজমু’ গ্রন্থে, গ্রন্থকার ‘তানবীহ’ নামক গ্রন্থে এবং অন্যান্য আলেমগণ”[সমাপ্ত]
✎ইমাম হাম্বলি (রহঃ)-এর অভিমত:
ইবনে কুদামা (রহঃ) তাঁর 'আল-মুগনী' গ্রন্থে (৪/৪৪৩) আরাফার দিনকে 'মহান ও মর্যাদাপূর্ণ
দিন' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন যে, এ দিনের রোযা দুই বছরের গুনাহ মোচন করে। ইবনে মুফলিহ (রহঃ) তাঁর 'আল-ফুরু' গ্রন্থে (৩/১০৮) এটিকে 'মহান ও সম্মানিত দিন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, এ দিনের রোযা এক বছরের গুনাহ মোচন করে। তিনি আরও বলেছেন যে, জিলহজের দশদিন রোযা রাখা মুস্তাহাব, যার মধ্যে ৯ তারিখের রোযা (আরাফার দিনের রোযা) সবচেয়ে বেশি তাগিদপূর্ণ এবং এটি ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত।
✎ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর অভিমত:
হানাফি মাযহাবের কিতাব 'বাদায়েউস সানায়ি' গ্রন্থে (২/৭৬) কাসানি (রহঃ) বলেন: "যারা হাজী নন তাদের জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, কারণ অন্য দিনগুলোর উপর এ দিনের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।"
✎ইমাম মালেক (রহঃ)-এর অভিমত:
মালেকী মাযহাবের আলেম খিরাশী তাঁর 'শারহু মুখতাসার খলিল' গ্রন্থে বলেছেন যে, যিনি হাজী নন তার জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। 'হাশিয়াতুদ দুসুকী' গ্রন্থেও এটিকে 'জোরালো-মুস্তাহাব' আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর হাজীর জন্য রোযা না-রাখা মুস্তাহাব; যাতে করে দোয়া করার জন্য শক্তি থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের সময় রোযা রাখেননি।”[সমাপ্ত]
✎শাইখ উছাইমীন (রহঃ)-এর ফতোয়া:
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) স্পষ্ট করে বলেছেন যে, যিনি হজ পালন করছেন না তার জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
❑২. হজ্জপালনকারীর
জন্য আরাফার দিনের রোযা:
হজ
পালনকারী যিনি আরাফার ময়দানে উপস্থিত থাকেন, তার জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা মুস্তাহাব। এর কারণ হলো, রোযা রাখলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন এবং আরাফায় অবস্থান ও দোয়া করার মতো গুরুত্বপূর্ণ
ইবাদতগুলো সঠিকভাবে আদায় করতে অসুবিধা হতে পারে।
✎উম্মে ফযল (রাঃ)-এর হাদিস:
ইমাম শাফেয়ি ও মাযহাবের অন্য আলেমগণ উম্মে ফযল (রাঃ)-এর হাদিসের ভিত্তিতে হজ্জপালনকারীর জন্য সেদিন রোযা না-রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তাঁদের অন্য একদল আলেম এটিকে মাকরুহ বলেছেন।
✎ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর অভিমত:
কাসানি (রহঃ) বলেছেন, হাজীর জন্যও এ দিনের রোযা রাখা মুস্তাহাব, যদি রোযা রাখার কারণে হাজী দুর্বল হয়ে আরাফায় অবস্থান ও দোয়া করা থেকে বাধাগ্রস্ত না হন। তবে যদি রোযা রাখতে গিয়ে হাজী দুর্বল হয়ে পড়েন, তাহলে রোযা রাখা মাকরুহ। কারণ রোযার ফজিলত অন্য বছর অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু আরাফায় অবস্থান ও দোয়া করার ফজিলত সাধারণত জীবনে একবারের বেশি অর্জন করা সম্ভব হয় না। তাই সেই ফজিলত অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উত্তম।
✎ইমাম মালেক (রহঃ)-এর অভিমত:
খিরাশী (রহঃ) বলেছেন, হাজীর জন্য রোযা না-রাখা মুস্তাহাব, যাতে করে দোয়া করার জন্য শক্তি থাকে। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হজ্বের সময় রোযা না রাখার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
✎শাইখ উছাইমীন (রহঃ)-এর ফতোয়া:
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেছেন, হাজীদের জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা সুন্নত নয়। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায়ী হজ্বকালে আরাফার দিন রোযা রাখেননি। সহিহ বুখারীতে মায়মুনা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার দিন রোযা রেখেছেন কিনা এ ব্যাপারে কিছু মানুষ সন্দেহে ছিল। তখন মায়মুনা (রাঃ) তাঁর জন্য এক পেয়ালা দুধ পাঠান, যখন তিনি আরাফার ময়দানে অবস্থান করছিলেন। তিনি দুধ পান করেন এবং লোকেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল, যা প্রমাণ করে তিনি রোযাদার ছিলেন না। তাই হজ্জপালনকারীর জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মাকরূহ; মুস্তাহাব নয়।
[মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন, খণ্ড ২০, প্রশ্ন ৪০৪]
❑ আরাফার দিনের বিশেষ ফজিলত:
- এই
দশ দিনের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন হলো আরাফার দিন (৯ই যিলহজ)। এই দিনে
আল্লাহ তা'আলা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন এবং নেয়ামত সম্পন্ন করেছেন।
- হাদীসে
এসেছে: উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ইয়াহুদী তাকে বলল: হে
আমীরুল মু'মিনীন, তোমাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা তোমরা পড়ে থাকো। যদি আমাদের
ইয়াহুদী জাতিতে তা নাযিল হতো, তাহলে আমরা সেই দিনটিকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ
করতাম। উমার (রাঃ) বললেন: কোন আয়াত? সে বলল: ‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার
নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’’- (সূরা মায়েদা: ৩)।
- ‘উমার (রাযি.)
বললেন, এটি যে দিনে এবং যে স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর উপর
অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা জানি; তিনি সেদিন ‘আরাফায় দাঁড়িয়েছিলেন আর সেটা ছিল জুমু‘আহর
দিন।
(সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫; (৪৪০৭, ৪৬০৬, ৭২৬৮) মুসলিম ৪৩/১ হাঃ ৩০১৭)
- আরাফার
দিনের সিয়াম (হজ্বযাত্রী ব্যতীত) দুই বছরের পাপ মোচন করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "আরাফার দিনের
সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, এটি পূর্ববর্তী এক বছর এবং
পরবর্তী এক বছরের পাপ মোচন করবে।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২,২৬৩৬-৩৮)
✎১. ফজিলত (গুনাহ মাফ):
আরাফার দিনের সিয়াম পালনের সবচেয়ে বড় ফজিলত হলো এর
মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়।
- হাদীস: আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আরাফার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা
হলে তিনি বলেন: "আরাফার দিনের সিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা
করি যে, তা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছর (এ দুই বছর)-এর পাপের কাফফারা হিসেবে
গ্রহণ করা হবে।" [সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২,২৬৩৬-৩৭]
* এই হাদীস হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
·
১। আরাফার দিনে হজ্জ সম্পাদনের কাজে রত থাকা ব্যক্তিগণ ছাড়া অন্য মুসলিমগণকে
আরাফার দিনে রোজা রাখার প্রতি এই হাদীসটি উৎসাহ প্রদান করে।
·
২। আরাফার দিনের একটি রোজা তার পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের পাপের
কাফ্ফারা হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো ছোটো ছোটো পাপের কাফ্ফারা এবং বড়ো পাপের ক্ষমা
প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তওবার আনুষঙ্গিক বিষয়ের সহিত তওবা করার প্রয়োজন রয়েছে।
·
৩। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা মোতাবেক আল্লাহর নিকটে সৎকর্মের দ্বারা মুসলিম
ব্যক্তি উচ্চমর্যাদা লাভ করতে পারবে।
✎২. আরাফার দিনের সিয়ামের বিধান (ফরয/সুন্নাত):
আরাফার দিনের সিয়াম ফরয বা ওয়াজিব নয়, বরং এটি মুস্তাহাব
(সুন্নাত)। অর্থাৎ, এটি পালন করলে অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু পালন না
করলে কোনো গুনাহ হয় না। তবে এর ফজিলত অনেক বেশি পালন করা প্রয়োজন।
✎৩. হাজীদের জন্য আরাফার দিনের সিয়াম:
যারা হজ্ব পালনের জন্য আরাফার মাঠে অবস্থান করছেন,
তাদের জন্য আরাফার দিনের সিয়াম মুস্তাহাব নয়, বরং সিয়াম পালন না করাই
উত্তম। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে:
✎হাদিসঃ০১- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আমল: উম্মুল ফাযল বিনতে হারেস (রাঃ)
থেকে বর্ণিত, আরাফার দিনে কিছু লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সিয়াম পালন নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছিল। তখন তিনি উটের ওপর আরাফাতে
অবস্থানকালে দুধ পান করলেন।
[সহীহ
বুখারী, হাদীস ১৯৮৮; ১৬৫৮, ইফা-১৬৮২,১৮৬-৬৬ ১৬৫১, ৫৩১৯, সহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ১৯৭১
১১২৩,২৫২২,২৫২৩,২৫২৫,২৫২৬, আল-বায়হাকি রচিত আল-সুনান আল-কবীর - হাদীস নং 7880] https://www.hadithbd.com/hadith/error/?id=25919 ]
✎হাদিসঃ০২- মায়মূনাহ
(রাযি.) হতে বর্ণিত যে, কিছু সংখ্যক লোক ‘আরাফাতের দিনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সওম পালন সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলে তিনি স্বল্প পরিমাণ দুধ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট পাঠিয়ে দিলে তিনি তা পান করলেন
ও লোকেরা তা প্রত্যক্ষ করছিল। তখন তিনি (‘আরাফাতে) অবস্থান স্থলে ওকূফ করছিলেন। তখন
তিনি তা পান করে নিলেন। আর লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে রইল।"
রেফারেন্সঃ [সহীহ বুখারী, হাদীসঃ ১৯৮৯, ইফাঃ ১৮৬৩] (মুসলিম ১৩/১৮, হাঃ ১১২৪), ২৫২৬,১১২৪,২৫০৩, আল-লুলু ওয়াল মারজান (হাদীস একাডেমী) : হাদিস নম্বর: ৬৮ , https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=25920 ]
এই হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফাতের দিনে রোজা রাখেননি, বরং দুধ পান করে তাঁর রোজা না থাকার বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন।
✎ হাদিসটির ব্যাখ্যা:
এই হাদিসটি হজ পালনকারী ব্যক্তিদের জন্য আরাফাতের দিনে রোজা না রাখার গুরুত্ব এবং কারণ তুলে ধরে। এর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
✎ হাজীদের জন্য রোজা না রাখা মুস্তাহাব: এই হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তি হজ পালন করছে এবং আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করছে, তার জন্য আরাফাতের দিনে রোজা না রাখা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়)। এর কারণ হলো, হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা (উকূফ)।
এই উকূফ অবস্থায় প্রচুর দোয়া, ইস্তিগফার এবং আল্লাহর কাছে বিনয় সহকারে প্রার্থনা করার প্রয়োজন হয়। রোজা রাখলে শারীরিক দুর্বলতা আসতে পারে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই, হাজীদের জন্য শক্তি ও সতেজতা বজায় রেখে আরাফার দিনের ইবাদতগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য রোজা না রাখাই উত্তম।
✎সন্দেহ দূর করা: সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফাতের দিনে রোজা রেখেছিলেন কিনা, সে বিষয়ে সংশয়ে ছিলেন। এই সংশয় দূর করার জন্য হযরত মায়মূনাহ (রাযি.) তাঁর কাছে দুধ পাঠালেন এবং তিনি তা পান করলেন। এটি ছিল সুস্পষ্ট প্রমাণ যে তিনি রোজা রাখেননি। এই ঘটনা সাহাবীদের মনে কোনো বিভ্রান্তি না থাকার সুযোগ করে দেয় এবং তাদের জন্য সুন্নাত অনুসরণ করা সহজ হয়।
✎সাধারণ মুসলিমদের জন্য আরাফার দিনের রোজা: উল্লেখ্য, এই হাদিসটি কেবলমাত্র হাজীদের জন্য প্রযোজ্য। যারা হজ পালন করছেন না, তাদের জন্য আরাফাতের দিনে রোজা রাখা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। বিভিন্ন হাদিসে এসেছে যে, আরাফাতের দিনের রোজা বিগত এক বছর এবং আগামী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে থাকে।
(যেমন: সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১১৬২, আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত)।
✎সারসংক্ষেপে, মায়মূনাহ (রাযি.)-এর এই হাদিসটি হাজীদের জন্য আরাফাতের দিনে রোজা না রাখার বৈধতা এবং মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণ। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মের মাধ্যমে এই বিধানটিকে সুস্পষ্ট করেছে, যাতে মুসলমানরা সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারে।]
আমাদের কাছে আবু আল-আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদের কাছে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক আস-সাগানী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদের কাছে আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদের কাছে মালিক বর্ণনা করেছেন, আবু আন-নাদর (উমর ইবনে উবাইদুল্লাহর গোলাম) থেকে, তিনি উমাইর (ইবনে আব্বাসের গোলাম) থেকে, তিনি উম্মুল ফাদল বিনতে আল-হারিস থেকে বর্ণনা করেছেন:
"কিছু লোক আরাফাহ্ দিবসে তাঁর (উম্মুল ফাদলের) কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর রোজা সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের কেউ বলছিলেন: 'তিনি রোজা রেখেছেন', আর কেউ বলছিলেন: 'তিনি রোজা রাখেননি।' তিনি (উম্মুল ফাদল) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক পেয়ালা দুধ পাঠালেন, যখন তিনি আরাফাহ্ দিনের সন্ধ্যায় (আরাফাতে) অবস্থান করছিলেন। তিনি (নবী) সেটি হাতে নিয়ে পান করলেন।""
এবং আমাদেরকে আবু আব্দুল্লাহ আল-হাফিজ আরও জানিয়েছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব আশ-শাইবাণী অবহিত করেছেন, তিনি বলেন: আমাদের কাছে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সালাম এবং হাসান ইবনে আব্দুস সামাদ বর্ণনা করেছেন, তাঁরা দু'জনই বলেছেন: আমাদের কাছে ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমি মালিকের কাছে এটি পড়েছি এবং তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
এই হাদিসটি বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ থেকে বর্ণনা করেছেন, এবং মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন। একইভাবে, সুফিয়ান আস-সাওরী, সুফিয়ান ইবনে উআইনাহ, আমর ইবনে আল-হারিস এবং অন্যান্যরা সালিম আবু আন-নাদর থেকে এটি বর্ণনা করেছেন।
[
সনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল - হাদীস নং 26297, 26287, মুওয়াত্তা মালিক - হাদিস নং 844, সহীহ ইবনে খুযায়মাহ - হাদীস নং
1923. সহীহ ইবনে হিব্বান - হাদীস নং
3676. আল-বায়হাকী কর্তৃক সুনান আল-কাবীর
- হাদীস নং 7883. আল-তাবারানী
রচিত আল-মুজাম আল-কবীর - হাদীস নং 19755. আরো
অনেক হাদিসে এসেছে]
(সহীহ ইবনে খুযাইমাহ - হাদীস নং ১৯২৩)
✎হাদীসের বাংলা অনুবাদ:"বিশর ইবনে মু'আয আল-আকাদী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, হাম্মাদ (অর্থাৎ ইবনে যায়েদ) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, আইয়ুব আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, ইকরিমা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি তাঁর মা উম্মুল ফজল থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আরাফাতে ইফতার (রোজা ভাঙলেন) করেছিলেন। তাঁকে দুধ আনা হয়েছিল এবং তিনি তা পান করেছিলেন।"
►ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যঃ
এই হাদীসটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় নির্দেশ করে:
✎১. হাজী সাহেবদের জন্য আরাফাতের দিনে রোজা না রাখার অনুমতি: এই হাদীস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, হজ পালনকারী ব্যক্তির জন্য আরাফাতের দিনে রোজা না রাখা জায়েয, বরং কোনো কোনো ব্যাখ্যানুসারে
এটিই পছন্দনীয়। কারণ, আরাফাতের দিনে রোজার কারণে দুর্বলতা আসতে পারে, যা হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
অংশ (যেমন - দোয়া, আল্লাহর স্মরণ) পালনে বাধা দিতে পারে।
✎২. ইবাদতের জন্য শক্তি বজায় রাখা: রোজা ভাঙার বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে, আরাফাতের আধ্যাত্মিক সাধনার (অবস্থান করা, দোয়া করা) জন্য শক্তি বজায় রাখা, ঐ দিনের রোজা রাখার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
✎৩. হাজী নন এমন ব্যক্তিদের থেকে ভিন্নতা: যারা হজ পালন করছেন না, তাদের জন্য আরাফাতের দিনে রোজা রাখা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং এটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু এই হাদীসটি বিশেষভাবে হাজীদের জন্য প্রযোজ্য।
✎৪.
দুধ পানের উল্লেখ: রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দুধ আনা হয়েছিল এবং তিনি তা পান করেছিলেন - এই বিস্তারিত তথ্যটি ঘটনাটির স্বাভাবিকতা
এবং বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
►হাদীসের বিশুদ্ধতা (সহীহ)
ইবনে খুযাইমার সংকলনের নামই "সহীহ", যা নির্দেশ করে যে তিনি তাঁর কঠোর মানদণ্ড অনুযায়ী এর অন্তর্ভুক্ত সকল হাদীসকে সহীহ বা বিশুদ্ধ মনে করতেন। এই হাদীসের বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা
(ইসনাদ) শক্তিশালী এবং হাদীস শাস্ত্রে সুপরিচিত:
- ✎বিশর ইবনে মু'আয আল-আকাদী: একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী।
- ✎হাম্মাদ ইবনে যায়েদ: হাদীসের অন্যতম
প্রধান ও নির্ভরযোগ্য ইমাম।
- ✎আইয়ুব (সম্ভবত আইয়ুব আস-সাখতিয়ানি): তাবেঈদের মধ্যে একজন মহৎ ব্যক্তি, অত্যন্ত বিশ্বস্ত
এবং নির্ভুল।
- ✎ইকরিমা: ইবনে আব্বাসের
একজন মহান ছাত্র ও আলেম। যদিও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু ঐতিহাসিক আলোচনা
আছে, তবে ইবনে আব্বাস থেকে তাঁর বর্ণনাগুলো সাধারণত গৃহীত,
বিশেষ করে যখন অন্য সূত্রে তার সমর্থন পাওয়া
যায়।
- ✎ইবনে আব্বাস: সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম জ্ঞানী।
- ✎উম্মুল ফজল: একজন সম্মানিত
মহিলা সাহাবী।
এই
হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মতো অন্যান্য প্রধান সহীহ হাদীস গ্রন্থগুলোতেও
পাওয়া যায়, যা এর বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতা আরও নিশ্চিত করে।
উম্মুল ফজলের (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের মূল বার্তাটিকে বিভিন্ন সহীহ হাদীস গ্রন্থে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রমাণ করে যে, এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
► (সকল বর্ণনায় একই):
এই সমস্ত বর্ণনা একই মূল ঘটনা প্রকাশ করে:
১. ✎স্থান ও সময়: আরাফাতের দিন, আরাফাতের ময়দান।
২. ✎বিতর্ক: উপস্থিত সাহাবীগণের মধ্যে এই বিষয়ে মতভেদ ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা রেখেছেন কি রাখেননি। ৩. ✎উম্মুল ফজলের (রাঃ) পদক্ষেপ: তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এক পেয়ালা দুধ পাঠালেন।
৪. ✎রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাজ: তিনি উটের পিঠে আরোহনরত অবস্থায় অথবা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সেই দুধ পান করলেন।
৫. ✎তাৎপর্য: তাঁর এই কাজটি প্রমাণ করে যে তিনি রোজা রাখেননি, যা আরাফাতের দিনে হাজীদের জন্য রোজা না রাখার অনুমতি (এবং উৎসাহিত করা) নির্দেশ করে, যেন তারা ইবাদত ও দোয়ার জন্য শক্তি বজায় রাখতে পারেন।
►বিস্তারিত অনুরূপ বর্ণনা
আরাফাতে দাঁড়ানো ব্যক্তির জন্য রোজা
ভাঙার জন্য কী কী পরামর্শ দেওয়া উচিত, যাতে সে তার দুআ ও প্রার্থনার জন্য
শক্তি অর্জন করতে পারে।
1. https://hadithunlocked.com/muslim:1123a
2. https://hadithunlocked.com/malik:20-136
✎ইবনে হাজার রচিত ফাতহুল বারী থেকে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যা জানলে ক্লিক করুন_
1. https://hadithportal.com/index.php?show=hadith&h_id=1908&uid=0&sharh=31&book=33&bab_id=
- ✎হজ্বের কার্যাবলীর সুবিধার্থে: আরাফার দিন হজ্বের মূল রুকন
'উকূফে আরাফা' (আরাফাতে অবস্থান) পালিত হয়। এই দিনে দীর্ঘক্ষণ দু'আ, যিকির ও
ইবাদতে লিপ্ত থাকতে হয়। সিয়াম পালন করলে শারীরিকভাবে দুর্বলতা আসতে পারে,
যা হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই হাজীদের
জন্য এই দিনে সিয়াম না রেখে শারীরিক শক্তি বজায় রাখা এবং ইবাদতে অধিক
মনোনিবেশ করা মুস্তাহাব।
►৪. আরাফার দিনের সিয়ামের নিয়ত:
✎আরাফার
দিনের সিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আরবি নিয়ত মুখস্থ করে বলা জরুরি নয়।
মুসলিমদের জন্য যে কোনো নফল সিয়ামের মতো আরাফার দিনের সিয়ামের জন্যও কেবল মনে
মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট। অর্থাৎ, সকালে সেহরির জন্য উঠার সময় বা দিনের যেকোনো
সময় (যদি সিয়াম ভঙ্গকারী কিছু না খেয়ে থাকেন) সিয়াম পালনের ইচ্ছা পোষণ করাই
যথেষ্ট।
0 Comments