🌿📘রাস্তার উপর বসা নিষেধ, রাস্তার শিষ্টাচার - পথের অধিকার 🌟ব্যাখ্যা & সালাফগণের উক্তি2025 Book Created- Rasikul Islam,

🌿"রাস্তার হক" কী? — ভূমিকা🌟

————————————————

📌 সংজ্ঞা:

"রাস্তার হক" বলতে বোঝায়— রাস্তায় চলাফেরা, বসা বা ব্যবহারের সময় ইসলামী আদব ও নীতিমালা অনুযায়ী যেসব দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক, সেগুলোকেই রাস্তার হক বলা হয়।

             রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং আমাদের শিখিয়েছেন রাস্তার হক কী কী — অর্থাৎ কীভাবে একজন মুসলিম রাস্তায় শালীনতা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক শান্তি বজায় রাখবে।

🌟 রাস্তার হক – এক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী শিক্ষা

---

🔰 ভূমিকা: রাস্তার হক (অধিকার) একটি ইসলামী নৈতিকতাঃ

 

🌟 রাস্তা—এটি সমাজের এক জীবন্ত অধ্যায়। অথচ এই সাধারণ বিষয়টি আমরা গুরুত্বই দিই না। বরং এই গুলি অনেকে এড়িয়ে চলে, আবার অনেকেই এই বিষয়ে অজানা।

ইসলাম আমাদের প্রতিটি জীবনদিকেই আদব ও নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে, এমনকি রাস্তায় চলাফেরা ও রাস্তার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও।

🌟 রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন যে, রাস্তার উপর বসলে, তা যেনো নৈতিক দায়িত্ব ও ইসলামি শিষ্টাচারের সঙ্গে হয়। রাস্তা— এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ একে অপরের মুখোমুখি হয়, চলাফেরা করি, কথা বলি, বসি, কিংবা ব্যবসা করি এই রাস্তার উপরই।

বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ যাতায়াত করে, সমাজের ভালো-মন্দ অনেক কিছুই সেখানে প্রকাশ পায়।

🌟রাস্তা কেবল চলাচলের জায়গা নয়, এখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কথা বলে, ভদ্রতা ও অসভ্যতার দ্বৈরথ চলে — আর এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়।

🌟 ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল নামাজ, রোজা, হজ কিংবা ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং রাস্তার ব্যবহার, প্রতিবেশীর হক, পশু-পাখির প্রতি দয়া — সব কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে।

🌟 রাস্তার হক আদায় না করলে তা মানুষের কষ্ট ও সমাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে। রাস্তা কেবল চলার স্থান নয়, বরং একটি সামাজিক পরিবেশ। বরং এর কিছু “হক” বা অধিকার রয়েছে, যা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।

🌟রাস্তার ব্যবহারেও ইসলামের রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা। রাস্তা সবার জন্য, তাই একজন মুমিনকে অবশ্যই রাস্তার ন্যায্যতা ও আদব রক্ষা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়ে কিরামকে রাস্তার হক সম্পর্কে শিখিয়েছেন, যাতে সমাজে শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ব বজায় থাকে।

---

🕋 রাস্তার উপর বসা নিষেধ এবং রাস্তার হক আদায় 🕋

---

  হাদিস📘 আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রাস্তার উপর বসা হতে বিরত থাকো। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের রাস্তায় বসা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

কারণ, আমরা তথায় বসে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সমাধা করি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ

“তোমরা যদি বসতেই চাও বা বসতে বাধ্যই হও, তবে রাস্তার” হক আদায় করবে। সাহাবীগণ (আবার) জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! রাস্তার হক কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ চক্ষু বন্ধ রাখা (দৃষ্টি অবনত রাখা), কাউকে কষ্ট না দেয়া(ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা),  সালামের জবাব দেয়া, ভালো(সৎ) কাজের আদেশ করা এবং (অসৎ)মন্দ কাজের নিষেধ করা।

---

🔸আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত আছে, পথহারাকে পথ দেখানোও রাস্তার হক।"

🔸’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। আছে যে -

তোমরা মাযলূমের (অত্যাচারিতের) আর্তনাদে সাড়া দেবে এবং পথহারাকে পথ দেখাবে।” এটি কেবল রাস্তার আদব নয়, বরং ইমানের দায়িত্ব।

---

🌟"📚রেফারেন্স/দলিলঃ পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - সালাম।।

[ মিশকাতঃ ৪৬৪০-৪৬৬২ [১৩]; সহীহ বুখারী: 5900, 2360, ২৪৬৫, ৬২২৯; মুসলিম: ৫৬৪, ৪০৭৬, (২১২১)-১১৪, (২১৬১)-৩; আহমাদঃ ১১৩০৯, আবূ দাউদঃ 4138, 4244,  ৪৮১৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ঃ ২৪২১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীবঃ ৩০৭৫, আদাবুল মুফরাদঃ ৮৮১, মা‘রিফাতুস্ মুনান বায়হাক্বীঃ ৪২৪৪, সহীহ ইবনু হিব্বানঃ ৫৯৫-597,  ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীরঃ ১৭৯৩৯, ‘বায়হাক্বী’র কুবরাঃ ১৩৮৯৬, আল-বায়হাকী, আল-সুনান আল-কবীরঃ ১৮৫৫২,  ১২৬৫৭, আবি ইয়া'লা আল-মাওসিলির মুসনাদ, হাদিসঃ 1213 , আল-তাহাবী, মুশকিল আল-আথার: 148 ]।

---

প্রকাশনী: দারুসসালাম, রিয়াদ/কিন্ডার পাবলিকেশন, ভারত/মাকতাবা আস্-সালাফ–এ সকল প্রকাশনীর "সহীহ বুখারী ও মুসলিম" অনুবাদে এই হাদীস বিদ্যমান।

️রাবী: আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু), আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার((রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু), একই হাদীস একাধিক সনদে একইরূপ বর্ণিত হয়েছে।

---

🌟 এবার হাদিসের ব্যাখ্যা জানবো বিস্তারিত-

 

🕋রাস্তার হক- রাস্তার শিষ্টাচার- পথের অধিকার - সাধারণ শিষ্টাচার, রাস্তার আদব সমূহ ব্যাখ্যা 🌟    _🕌সহীহ হাদীস- সালাফ দের দৃষ্টিতে আলোচনা🕋  

---

🕋 রাস্তায় বসে থাকা এবং রাস্তার প্রাপ্য আদায় করা নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত🕋

---

ব্যাখ্যা:

🌟কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ হাদীসে সাহাবীদের প্রতি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ওয়াজিব ছিল না।

মূলতঃ এটা ছিল উৎসাহ প্রদানমূলক বা উত্তমতার নিরিখে। যদি সাহাবীগণ এটাকে ওয়াজিব মনে করতেন তাহলে তারা বারবার এটাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পেশ করতেন না।

️কোন মুসলিম, সে ছোট হোক বা বড়, তার ক্ষতি করা বা ক্ষতি করা জায়েজ নয়। বিশুদ্ধ ইসলামী শরিয়া সকলের অধিকার এবং স্বার্থ বিবেচনা করে।

️ এই হাদিসে, নবী (সাঃ) মুসলমানদেরকে রাস্তায়, বেঞ্চে, পালঙ্কে, চেয়ারে বা গদিতে বসার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। কারণ রাস্তায় বসার ফলে - বেশিরভাগ ক্ষেত্রে - মানুষের ক্ষতি হয়, তাদের পিছনে তাকিয়ে বিব্রত করা হয়, অথবা তাদের জন্য রাস্তা সংকীর্ণ করা হয়, এবং অন্যান্য জিনিস, এবং কারণ রাস্তায় বসে থাকা ব্যক্তি প্রলোভনের সম্মুখীন হতে পারে, অথবা অন্যদের এতে ভোগ করতে পারে, এবং অন্যান্য দুর্নীতির বিষয়,

✅রাস্তার হক সম্পর্কে একাধিক রিওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে, এসব হাদীস থেকে__

🌟 হাফিয ইবনু হাজার ‘আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) চিন্তা ভাবনা করে ১৪টি আদবের ইঙ্গিত প্রদান করেন।

️ সম্মানিত ভাষ্যকার ১৪টি আদবকে একত্রিত করে ৩টি চরণে উল্লেখ করেন যা নিচে দেওয়া হলো__

📗আমি রাস্তায় বসতে চাওয়া ব্যক্তির জন্য সৃষ্টির সেরা মানুষের (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) নিকট থেকে আদাবসমূহ একত্রিত করেছি:

1.সালাম বিস্তার কর, সালাম প্রদানকারীর উপযুক্ত জবাব। ইসলামে সালাম ছড়ানো এবং তার জবাব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ আদব। রাস্তার মানুষকেও এ সম্মান দিতে হবে।

2) সুন্দর কথা বল। সমাজে নেক কাজের প্রসার করা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ দিক।

 3, 4) হাঁচিদাতা ও দাও, 5, 6) বোঝা বহনকারী ও মাযলূমকে সাহায্য কর,

7) দুঃখির সাহায্যে পাশে দাঁড়াও, 8, 9, 10) পথিক ও দিশেহারাকে পথের দিশা দাও,

11) সৎকাজের আদেশ কর, মন্দ কাজ থেকে বাধা দান কর, বং যদি তারা তাদের সামনে কিছু খারাপ দেখে, তাহলে তাদের কর্তব্য হলো তা নিন্দা করা। 

অন্যায় ও অন্যদুর্নীতির প্রতিবাদ করা, যেন সমাজে অশান্তি না ছড়ায়।

12) কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দাও, পথচারীকে কষ্ট দেওয়া, শব্দদূষণ, পথ রোধ করে বসা, গালি দেওয়া – এগুলো সম্পূর্ণ হারাম। কথা বা কাজে পথচারীদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা।

13) দৃষ্টি অবনত রাখ, হারাম বা অশ্লীল জিনিস দেখার মাধ্যমে হৃদয়ের পবিত্রতা নষ্ট হয়। এটি ব্যভিচারের প্রথম ধাপ। সামনে দিয়ে যাতায়াতকারী মহিলাদের থেকে দৃষ্টি অবনত রাখা, কারণ প্রয়োজনে রাস্তায় মহিলার গমন করা নিষেধ নয়। 

14) আমাদের প্রভু (আল্লাহর) বেশি বেশি জিকর্  কর।

---

📘মন্দ কোন কিছু চোখে পড়া ও সৎকর্ম বাধাগ্রস্ত হওয়া। এসব ক্ষেত্রে আদেশ করা ও নিষেধ করা মুসলিমের ওয়াজিব দায়িত্ব। যদি সে এগুলো পরিহার করে তাহলে সে অপরাধী হবে। অনুরূপভাবে সে তার নিকটে গমনকারী ও সালাম প্রদানকারীর মুখোমুখি হয়। কখনো এদের সংখ্যা এত বেশি হয় যে, তাদের জবাব দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে। অথচ তার জবাব দেয়া ওয়াজিব। ফলে সে পাপী হয়ে যায়। আর মানুষকে ফিৎনা ও সাধ্যাতিরিক্ত কোন কিছুর সম্মুখীন না হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সে কারণ ঐসব বিষয়ের নিষ্পত্তিকল্পে শারী’আত প্রণেতা মানুষদেরকে রাস্তায় না বসতে সচেতন করেছেন। এর পরেও সাহাবীরা যখন তাদের প্রয়োজন,

যেমন- তাদের পারস্পারিক খোঁজ-খবর নেয়া, দীন সম্পর্কে আলোচনা, বৈষয়িক কল্যাণকর কর্মকাণ্ড, ভালো জিনিসের ব্যাপারে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আত্মিক প্রশান্তির কথা রসূলের সামনে তুলে ধরলেন তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে উপরোক্ত সমস্যা দূরীকরণে সুনির্দেশনা দান করলেন।

📘রাসূল ﷺ মানুষের চরিত্র, সমাজনীতি ও সম্মান রক্ষার জন্য সামান্য বিষয়েও শিক্ষাদান করেছেন। রাস্তায় বসা তখনকার সমাজে একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। এতে মানুষ অনেক সময় পথচারীদের কষ্ট দিত, অশালীনভাবে তাকাত, বিরক্ত করত বা গীবত-অপবাদে লিপ্ত হতো।

এজন্য রাসূল ﷺ নিষেধ করলেন। তবে যদি প্রয়োজনেই বসতে হয়, তবে পাঁচটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, যেন কারও ক্ষতি না হয় এবং সমাজে আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।

 

🌸হাদিসের সরল ব্যাখ্যা:

এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে রাস্তায় বসা বা আড্ডা দেওয়া থেকে সতর্ক করেছেন। এর কারণ হলো, ছোট-বড় কোনো মুসলিমেরই ক্ষতি করা জায়েজ (বৈধ) নয়। ইসলাম মানুষের অধিকার ও সুবিধার কথা সব সময় গুরুত্ব দেয়।

 

🌸নবী (সাঃ) এই হাদিসে মুসলমানদেরকে রাস্তায়, বেঞ্চে, চেয়ারে বা অন্য কোনো বসার জায়গায় আড্ডা দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ, রাস্তায় বসলে সাধারণত পথচারীদের ক্ষতি হতে পারে। যেমন:

🌸বিব্রত করা: পেছনে তাকিয়ে বা অন্য কোনোভাবে পথচারীদের বিব্রত করা হতে পারে।

🌸রাস্তা সংকীর্ণ করা: বসার কারণে রাস্তা সরু হয়ে যায়, ফলে পথচারীদের চলাচল কঠিন হয়।

🌸অথবা অন্যদেরকেও ফিতনার শিকার করতে পারে।

🌸যখন সাহাবিরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন যে, তাদের জন্য রাস্তায় না বসে উপায় নেই কারণ সেগুলো তাদের মিলনস্থল, যেখানে তারা নিজেদের ধর্মীয় ও পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং মনকে শান্তি দেন, তখন তারা বুঝতে পারছিলেন যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই সতর্কবাণীটি সম্ভবত পুরোপুরি নিষেধ ছিল না, বরং এটা ছিল এক ধরনের পরামর্শ। কারণ সাহাবিরা জানতেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কখনোই কোনো ভালো জিনিস নিষিদ্ধ করেন না বা কোনো ক্ষতিকর জিনিসকে অনুমতি দেন না। অথবা, তাদের ধারণা ছিল যে এই নিষেধটা হয়তো রাস্তার উপর বসে থাকার কারণে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য, সরাসরি বসার জন্য নয়।

 

তারা যদি জানতেন যে এটা সম্পূর্ণ নিষেধ, তাহলে তাঁরা কখনোই রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এমন প্রশ্ন করতেন না। তাই নবী (সাঃ) তাদের উত্তরে বুঝিয়ে দিলেন যে, এই নিষেধের মূল উদ্দেশ্য হলো রাস্তায় বসা ব্যক্তিদের কারণে যেন পথচারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। তাই তিনি (সাঃ) বললেন: "যদি তোমরা একসাথে বসার জন্য জোর করো, তাহলে রাস্তার হক আদায় করো।"

🌸সাহাবিরা তখন রাস্তার হক কী, তা জানতে চাইলেন, এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উত্তরে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বললেন:

 

🌸দৃষ্টি নিচু রাখা: এর মানে হলো, যা দেখা জায়েজ নয়, তা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া, এবং যেসব জিনিস প্রলোভন বা ফিতনার কারণ হতে পারে, সেগুলো দেখা থেকে বিরত থাকা। যেমন, মহিলাদের দিকে তাকানো যাবে না। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, দৃষ্টি নিচু রাখলে নারী ও পথচারীরা প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

 

🌸ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা: এর অর্থ হলো, কথা বা কাজ, জিহ্বা বা হাত দিয়ে মানুষের ক্ষতি না করা। যেমন:

কাউকে গালাগাল করা, অপমান করা, ছোট করা বা নিন্দা করা যাবে না।

অন্যের নামে গীবত (পিছনপেছন সমালোচনা) করা যাবে না।

কারো অনুমতি ছাড়া তার জিনিসপত্র নেওয়া যাবে না।

রাস্তায় পানি ছিটানো যাবে না, যাতে কেউ পিছলে না পড়ে।

পথচারীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে এমন কিছু রাখা যাবে না, যেমন আবর্জনা বা কাঁটা।

নিজের বসার জায়গা বা প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে রাস্তা সংকীর্ণ করা যাবে না, যাতে তাদের বাড়ির মহিলাদের বা পথচারীদের স্বাধীন চলাচল বাধাগ্রস্ত না হয়।

এর ফলে মহিলারা হয়তো রাস্তায় বের হয়ে তাদের কাজ করতে দ্বিধা করতে পারে।

এই সব ধরনের ক্ষতি বন্ধ করা উচিত, এমনকি পশুদের ক্ষতি করা থেকেও বিরত থাকা উচিত।

 

🌸সালামের জবাব দেওয়া: যখন কোনো পথচারী সালাম দেয়, তখন তার জবাব দেওয়া ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক)। এটা পথচারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অংশ। সালাম হলো ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের প্রতীক। বসা ব্যক্তির উচিত নয় পথচারীদের সালামে বিরক্ত হওয়া। বরং, যে সালাম দিয়েছে, তাকে আরও ভালো বা অন্তত সমানভাবে সালামের জবাব দেওয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা কুরআনে বলেছেন: "আর যখন তোমাদেরকে সালাম দেওয়া হয়, তখন তার চেয়ে ভালোভাবে সালাম দাও, অথবা (অন্তত) সমানভাবে।" (আন-নিসা: ৮৬)

 

🌸ভালো কাজের আদেশ দেওয়া: এর অর্থ হলো, মানুষকে ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করা এবং তাদের সৎ পথে চলতে সাহায্য করা। যদি কেউ কোনো ভালো কাজে উৎসাহিত হওয়ার প্রয়োজন মনে করে, তাহলে তাকে সঠিক পথের নির্দেশ দেওয়া।

 

🌸মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা: এর অর্থ হলো, যখন কোনো মন্দ বা নিন্দনীয় কাজ চোখে পড়ে, তখন সেই কাজটি করা ব্যক্তিকে সতর্ক করা এবং অন্যদেরকে তা থেকে বিরত থাকার জন্য ভয় দেখানো। তবে, এই আদেশ ও নিষেধ করার সময় নম্রতা অবলম্বন করা উচিত, কাউকে কটু কথা বলা বা ক্ষতি করা উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি দু'জন লোক ঝগড়া বা মারামারি করে, তাহলে তাদের থামানো এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করার নির্দেশ দেওয়া উচিত। যদি কোনো যুবক কোনো মেয়ের পিছু নেয় বা তার পথ আটকে দেয়, তাহলে তাকে উপদেশ দেওয়া উচিত এবং যতটা সম্ভব তাকে এমন কাজ থেকে বিরত রাখা উচিত, তবে কোনো রকম বাড়াবাড়ি বা ক্ষতি না করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছোটখাটো উপকারের চেয়ে বড় ক্ষতি প্রতিরোধ করা বেশি জরুরি।

 

🌸এই হাদিসটি সৎ আচরণ এবং সামাজিক শিষ্টাচারের এক চমৎকার শিক্ষা দেয়। এতে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: ভালো কথা বলা, পথ হারানো মানুষকে পথ দেখানো, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা, নির্যাতিতকে সাহায্য করা, মালপত্র বহনে সাহায্য করা ইত্যাদি।

 

এই হাদিসটি মুসলমানদেরকে একে অপরের সাথে ভালো ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। রাস্তায় বসা অবস্থায় অনেক মানুষের সাথে দেখা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ হয়। তাই, সব পরিস্থিতিতে অন্যদের সাথে ভালো আচরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

🌸ফাতহুল মুন'ইম থেকে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যা:

🌟সাধারণ অর্থ:

আরবদের ঘরবাড়ি ছিল প্রশস্ত, রাস্তার ধারে উঠোন ছিল, প্রায়শই দরজা ছিল না, এবং প্রায়শই রাস্তায় বেঞ্চ ছিল। তারা এমন একটি জাতি ছিল যারা জীবিকা নির্বাহের জন্য খুব কম সময় ব্যয় করত, কারণ উপার্জনের সুযোগ সীমিত ছিল, তাই তারা রাস্তার প্রশস্ত জায়গায় দলবদ্ধভাবে জড়ো হয়ে তাদের বিশাল অবসর সময় পূরণ করত।

 

এই পরিস্থিতিতে, এটি রাস্তা দিয়ে পথচারীদের ক্ষতি করত এবং তাদের কাজে এবং তাদের প্রয়োজন মেটানোর রাস্তাগুলি সীমিত ছিল। বসার জন্য জায়গার বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না, এবং যখন রাস্তায় বসে থাকা সাধারণত মানুষে পরিপূর্ণ থাকে তখন এটি কীভাবে হতে পারে?

 

🌟সুতরাং, রাস্তায় বসে থাকা বন্ধ করে ক্ষতি এড়ানো যায়, যান চলাচল বন্ধ করে নয়। তাই বিজ্ঞ আদেশ ছিল: রাস্তায় বসে থাকা থেকে সাবধান থাকো। বিজ্ঞ ব্যক্তি জানেন যে এই আদেশ কার্যকর করা কঠিন, কিন্তু তিনি এটি জারি করেছিলেন যাতে মানুষ আল্লাহর কাছে একটু ছাড়ের জন্য প্রার্থনা করে। এর ফলে তাদের প্রতি আল্লাহর দয়া প্রকাশ পাবে এবং তারা সেই ছাড়ের ফলে আসা অন্য আদেশগুলো মেনে চলবে।

যেমন, যারা এই ছাড় পেয়েছিলেন, তারা বলেছিলেন: "রাস্তায় না বসে আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। এখানে ঘরের মহিলাদের লজ্জা থেকে দূরে, সহজে একত্রিত হওয়া যায়।"

 

🌟নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: "যদি তোমরা রাস্তায় বসতে বাধ্য হও, তাহলে পথচারীদের দিকে এমনভাবে তাকাবে না, চোখ টিপবে না, ইশারা করবে না, কারো নামে নিন্দা করবে না, পরনিন্দা করবে না, অশ্লীল কিছু দেখাবে না, খারাপ চিন্তা করবে না, তাদের বিরক্ত করবে না বা তাদের সাথে বিরোধ করবে না।

বরং, তাদের রাস্তায় তোমার উপস্থিতি তাদের প্রতি দয়ার কারন বা কাজ হয় বা হোক।

তাদের সালামের জবাব দাও, যারা হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে তাদের জন্য দোয়া করো, পথ হারানো মানুষকে পথ দেখাও, বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করো, অত্যাচারিতকে সাহায্য করো, অত্যাচারীকে ঠেকিয়ে রাখো, যারা সাহায্য চায় তাদের সাহায্য করো, যারা কষ্টে আছে তাদের সাহায্য করো, ভালো কাজের আদেশ দাও এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করো।"

🌟আরবি ভাষার তদন্ত:

(রাস্তায় বসে থাকা থেকে সাবধান) এটা সতর্ক করার একটা ধরণ। এর আসল রূপ হল: আমি তোমাকে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করছি, এবং আমি তোমাকে রাস্তায় বসে থাকার ব্যাপারে সতর্ক করছি। বারবার ব্যবহারের কারণে "আমি সতর্ক করছি" ক্রিয়াপদটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

 

(তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের সমাবেশ ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই।): "বা" শব্দের "দালে" একটি জোর ("শাদ্দা") আছে, যার অর্থ বিকল্প বা আশ্রয়। অর্থাৎ, তাদের ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই, কারণ তারাই আমাদের মিলনস্থল। এর আরেকটি অর্থ হলো 'মুক্তি'। যেমন বলা হয়: "এ থেকে কোনো মুক্তি নেই।" এর মানে হলো: "আমাদের বসার জায়গা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, আমরা সেগুলো ছাড়া চলতে পারি না, কারণ সেগুলো আমাদের মিলনস্থল।"

 

(আমরা এটি সম্পর্কে কথা বলি): এটা অনুমোদিত কথা বলার একটি ধরণ, একটি নতুন বাক্য যা অলংকারপূর্ণ ভাবে বলা হয়েছে। যেন কেউ জিজ্ঞেস করছে: "আপনারা এটা নিয়ে কী করেন?" তাই বলা হয়েছিল: "আমরা অনুমোদিত হাদিস সম্পর্কে কথা বলি।" আবু তালহার হাদিসে তারা বলেছিল: "আমরা শুধু কোনো ক্ষতি করার জন্য বসিনি, আমরা বসে কথা বলছিলাম এবং আলোচনা করছিলাম।"

 

(আর যদি তুমি কাউন্সিলে যাওয়ার জন্য জোর দাও): "কাউন্সিল" শব্দের 'লাম'-এ 'কাসরা' (নিচের জের) থাকলে এর অর্থ হয় 'বসার জায়গা তৈরি করা'। কেউ কেউ 'লাম'-এ 'ফাতহা' (উপরের জবর) দিয়ে বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ 'বসা'। অন্য বর্ণনায় আছে: "যদি তুমি কাউন্সিলে আসার পর থেকেই এসে থাকো।" আরেক বর্ণনায়: "যদি তুমি কিছুই না করার জন্য জোর দাও।" একটি হাদিসে আছে: "হামজায় কাসরা (জের) এবং 'লা' নঞর্থক", এর অর্থ: "যদি না তুমি তা ত্যাগ করো, তাহলে অমুক অমুক করো।"

 

(রাস্তাগুলোকে তাদের প্রাপ্য দাও): একটি বর্ণনায় এর অর্থ 'তাদের প্রাপ্য অধিকার'। 'রাস্তা' শব্দটি পুরুষ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়ই হতে পারে। আহমদের বর্ণনায় আছে: "তোমাদের মধ্যে যে কেউ সমতলভূমিতে বসে, তাকে তার প্রাপ্য দিতে হবে।"

 

(এবং তার অধিকার কী?): একটি বর্ণনায়: "এবং রাস্তার অধিকার কী?"

 

(দৃষ্টি নিচু রাখা, অন্যদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ দেওয়া এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা): একটি বর্ণনায় এর সাথে যোগ করা হয়েছে: "ভালো কথা বলা" এবং আরেক বর্ণনায়: "পথ হারানোকে পথ দেখানো" এবং "হাঁচিদাতার জন্য দোয়া করা" যদি সে আল্লাহর প্রশংসা করে। একটি বর্ণনায়: "দুঃখীকে সাহায্য করো এবং হারানোকে পথ দেখাও।" আরেক বর্ণনায়: "পথ দেখাও" এবং "নিপীড়িতকে সাহায্য করো।" আহমদ ও তিরমিযীর বর্ণনায়: "পথ দেখাও" এবং "নিপীড়িতকে সাহায্য করো।" বাজ্জারের বর্ণনায়: "ভার বহনে সাহায্য করো।" তাবারানীর বর্ণনায়: "আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো" এবং তার সাথে: "মূর্খকে পথ দেখাও এবং নিপীড়িতকে সাহায্য করো।"

 

---

🌸রাস্তার হক কেন গুরুত্বপূর্ণ?

রাস্তা হলো মানুষের চলাচলের স্থান। সেখানে বসা সামাজিক, নৈতিক ও নিরাপত্তার দায়িত্বের সাথে জড়িত। যারা সেখানে বসে, তারা যেন:

✅অপরের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।

✅বেহায়াপনা বা দৃষ্টি-অশ্লীলতায় না লিপ্ত হয়।

✅সৌজন্যমূলক আচরণ করে, যেমন সালামের উত্তর দেয়।

✅সমাজে ন্যায়ের কথা বলে ও অন্যায় প্রতিহত করে।   

✅ ‘‘আর পথিককে পথ দেখানো’’। 

✅ ‘‘বিভ্রান্ত বা বিপথগামীকে পথের দিশা দেয়া’’ থেকে অধিকতর ব্যাপক অর্থসম্পন্ন।

(‘আওনুল মা’বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮০৮)

---

📚কুরআন এর প্রাসঙ্গিক আয়াতঃ

 

📗“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে।”

[সূরা আন-নূর, ২৪:৩০]

🌿 ১. দৃষ্টিকে সংযত রাখা:

“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে।”

📚 সূরা আন-নূর – ২৪:৩০

🔹এই আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রাস্তায় চলার সময়ও দৃষ্টিকে সংযত রাখা ঈমানদারদের একটি দায়িত্ব।

 

🌿 ২. কষ্ট না দেওয়া:

“আর যারা ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তাদের অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও, তারা এক গুরুতর অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহের বোঝা বহন করে।”

📚 সূরা আহযাব – ৩৩:৫৮

রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথ আটকে রাখা, শব্দ বা ধোঁয়ায় কষ্ট দেওয়া, জোরে হর্ন বা বাজনা ইত্যাদি — এসবই মুমিনকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে পড়ে।

 

 

🌿 ৩. সালামের জবাব দেওয়া:

“যখন তোমাদের সালাম করা হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তমভাবে উত্তর দাও, অথবা অনুরূপ জবাব দাও।”

📚 সূরা আন-নিসা – ৪:৮৬

🔹রাস্তার আদব হলো, পরিচিত বা অচেনা মুসলিম ভাই/বোন সালাম দিলে জবাব দেওয়া।

 

🌿 ৪. সৎ কাজের আদেশ:

“তোমাদের মধ্য থেকে এমন এক দল থাকা উচিত যারা মানুষের কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ দেবে।”

📚 সূরা আলে ইমরান – ৩:১০৪

🔹রাস্তায় অশালীনতা বা অন্যায় আচরণ দেখলে সৌজন্যপূর্ণভাবে নসীহত করা মুসলিমের দায়িত্ব।

 

🌿 ৫. মন্দ থেকে নিষেধ:

“তোমরা উত্তম জাতি, মানবতার কল্যাণে গঠিত; তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজে নিষেধ করো।”

📚 সূরা আলে ইমরান – ৩:১১০

🔹রাস্তার পরিবেশ যদি অন্যায়ের জায়গা হয়, তবে প্রতিবাদ করা ঈমানের চিহ্ন।

 

"রাস্তার হক" বিষয়টি কোনো সামাজিক নিয়ম নয় বরং কুরআনুল কারীম ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী বিধান। রাস্তা ব্যবহারে কুরআনি নীতিমালাগুলো মেনে চলা আমাদের ঈমানেরই দাবি।

---

💬 সালাফে সালেহীনের ব্যাখ্যা ও বাণী🌟

🌟ইমাম নববী (রহ.) বলেন:

🌸এই হাদিসটি অনেক বিস্তৃত এবং এর বিধানগুলো স্পষ্ট। এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাকা উচিত। ক্ষতি প্রতিরোধের মধ্যে রয়েছে: কারো গীবত না করা, কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করা, পথচারীদের অবজ্ঞা না করা এবং রাস্তা সংকীর্ণ না করা। এমনকি যখন বসা মানুষরা এমন হয় যাদেরকে পথচারীরা ভয় পায় বা যাদের কারণে পথচারীরা ব্যস্ততার জন্য পাশ দিয়ে যেতে দ্বিধা করে, কারণ তারা ওই জায়গা ছাড়া অন্য কোনো পথ খুঁজে পায় না, তখনও এই বিধান প্রযোজ্য।

রাস্তায় বসে থাকা মানে রাস্তার দিকে খোলা বাড়ির উঠোনে বসে থাকা, রাস্তার পাশে থাকা বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা, বারান্দায় বসে থাকা, বসে থাকা মানে দাঁড়িয়ে থাকা এবং অকারণে রাস্তায় হাঁটার মতো।

এই সবকিছুর পেছনের প্রজ্ঞা হলো মন্দ কাজের পথ বন্ধ করা। কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের কাছাকাছি গেলে সেগুলোর দিকেই মানুষ বেশি ঝুঁকে পড়ে। তাই শরীয়ত প্রণেতা মানুষকে খারাপ কাজের পথ বন্ধ করার জন্য রাস্তায় বসা থেকে বিরত থকার আহ্বান জানিয়েছেন।

🌸সাহাবিদের প্রতিক্রিয়া কিন্তু এই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ছিল না, বরং এটা ছিল একটা ছাড়ের অনুরোধ এবং প্রয়োজন ও বাস্তবতার উপলব্ধি। বিচারক আইয়াদ বলেন: "এটা প্রমাণ করে যে তাদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদেশ বাধ্যতামূলক ছিল না, বরং এটা ছিল উৎসাহ দেওয়া এবং পছন্দের মাধ্যমে, কারণ যদি তারা এটাকে বাধ্যতামূলক মনে করতেন, তাহলে তারা এভাবে এর পুনর্মূল্যায়ন করতেন না। যারা আদেশকে বাধ্যতামূলক মনে করেন না, তারা এটাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।"

 

"যখন কেউ এমনভাবে রাস্তার পাশে বসে, যার কারণে পথচারীরা ভয় পায় কিংবা কেউ বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ খোঁজে অথবা কাজে যেতে দ্বিধা বোধ করে — এটাও কষ্টদায়ক বস্তু বলে গণ্য হবে।"

“রাস্তার হক আদায় না করে বসে থাকা হারাম পর্যায়ের গোনাহ হয়ে যেতে পারে যদি কারও দৃষ্টিতে কষ্ট, অনাচার বা অন্যায় হয়।”

ইমাম নাওয়াবী (রহ.) বলেন: "রাস্তার হক পালনে গীবত, হেয় করা, অশালীনতা, গালিগালাজ, ও কুদৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"

[শরহ সাহীহ মুসলিম, ইমাম নববী,(১৪/১১২)],  (শারহুন নাবাবী ১৪শ খন্ড, হাঃ ২১২১)

---

🌟ইবনে রজব (রহ.) বলেন:

🌸 “এই হাদীসটি ইসলামী শিষ্টাচার, মুসলিমদের পারস্পরিক হক এবং সামাজিক ন্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, রাস্তাঘাটের কিছু শিষ্টাচার ও হক রয়েছে যা পালন করা রাস্তা বা জনসমক্ষে বসা তখনই বৈধ, যখন সেখানে ইসলাম নির্ধারিত হকগুলো (যেমন: চোখ নামিয়ে রাখা, কষ্ট না দেওয়া ইত্যাদি) আদায় করা হয়।”

“রাসূল ﷺ এই হাদীসে রাস্তার প্রতি যে হক নির্ধারণ করেছেন, তা আসলে সমাজে মানুষের নিরাপত্তা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ইসলামী সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি বড় দৃষ্টান্ত। রাস্তার আদব রক্ষা করা ছাড়া সেখানে বসা অনুচিত।”

📚 ফতহুল বারি (২/৪৩৭) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪০১; [জামি’উল উলূম ওয়াল হিকাম, হাদীস নম্বর ২০-এর ব্যাখ্যা]

🌟হাসান আল বাসরী (রহ.) বলেন:

🌸“যে ব্যক্তি রাস্তার উপর বসে আর মানুষকে কষ্ট দেয়, সে যেন আল্লাহর অভিশাপ কামনা করে।”

“তুমি যদি রাস্তার পাশে বসো, তাহলে জেনে রেখো—তুমি প্রতিটি পথচারীর উপর নজরদার হিসেবে বসেছ।

অতএব, তাদের কোনো ক্ষতি করো না, বরং কেউ যদি সাহায্যের প্রয়োজন করে, তাকে সাহায্য করো।”

📚উৎস: আল-আদাবুশ্ শর‘ইয়্যাহ— ইবনুল মুফলিহ (খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩০৭), [মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, ৮/৪৫৫]

 

🔹এখানে তিনি রাস্তার হককে শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কতার দিক দিয়ে দেখাননি, বরং “ইবাদত” ও “সামাজিক দায়িত্ব”-এর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

🔹কারণ, একজন মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি হল: "রাস্তার ধারে বসা মানেই মানুষের নিরাপত্তা রক্ষা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা, এবং সুযোগ পেলে সহায়তা করা।"

📖 সহীহ মুসলিম: ৫৭৭২

---

🌟ইবনু হাজার ‘আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ

 🌸“রাস্তায় বসে কষ্ট দেওয়া বলতে বোঝানো হয়—

(১) এমনভাবে বসা যাতে রাস্তা সংকুচিত হয়ে যায়, অথবা

(২) বাড়ির দরজার সামনে বসা যাতে পথচারী বা বাড়ির লোকজন কষ্ট পায়, বা

(৩) কোনো গোপনীয় বিষয় যেমন পরিবারের নারীদের দেখা যাওয়ার মতো কিছু উন্মুক্ত হয়ে যায়।”

অর্থাৎ:

 “বাড়ির দরজার সামনে এমনভাবে বসা যাতে নারীদের গোপনীয়তা উন্মুক্ত  

  হয়ে পড়ে—এটা রাস্তার কষ্টদায়ক বস্তু।”

সহীহ বুখারী-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী”🔸 খণ্ড: ১১🔸 পৃষ্ঠা: ১১, 🔸 হাদীস: ২৪৬৫ এর ব্যাখ্যা।

🔹এই ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায়—ইসলাম শুধু পথচারীর নিরাপত্তা নয়, বরং মানুষের গোপনীয়তা ও পারিবারিক মর্যাদাও রক্ষার শিক্ষা দেয়।

🔹 রাস্তার হক মানে শুধু কষ্ট না দেওয়া নয়, বরং প্রাইভেসি রক্ষা করাও ইসলামের নির্দেশনা।

---

ইবনু হাজার (রহ.) স্পষ্ট করেছেন যে রাস্তার হকের মধ্যে রয়েছে:

✅রাস্তা সংকুচিত না করা,

✅বাড়ির দরজার সামনে না বসা,

✅পরিবারের গোপনীয়তা রক্ষা করা।

এই সবকিছুই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর (কষ্ট না দেওয়া)-র ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত।

📌 ১। বিশেষভাবে নারীদের ব্যাপারে উক্ত ব্যাখ্যার গুরুত্ব:

🔹বাড়ির দরজার সামনে বসে থাকা—এটি এমন এক সামাজিক অভ্যাস যা নারীদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণ হতে পারে।

🔹রাস্তা সংকুচিত হলে পথচারী নারী বা শিশুদের চলাচলও বিঘ্নিত হয়।

🔹এমন বসা যেখানে নারীদের চলাচল, পর্দা বা সম্মান বিপন্ন হতে পারে—ইসলামে তা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয।

---

📌শিক্ষণীয় দিক:

ইসলাম শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য বা শিষ্টাচার নয়, বরং নারীর মর্যাদা রক্ষাকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে দেখেছে।

রাস্তা, জানালা, বারান্দা বা গলির মুখে এমনভাবে বসা যা নারীর চলাচল বা পর্দার বিঘ্ন ঘটায়—তাও  (কষ্ট দেওয়া)"-র অন্তর্ভুক্ত।

রাস্তা দখল নয়, পথ উন্মুক্ত রাখা—এটা একপ্রকার ইবাদত এবং সামাজিক তাকওয়ার প্রকাশ।

📌 আজকের বাস্তবতায়:

🔴রাস্তার পাশে উচ্চস্বরে আড্ডা, বাড়ির দরজার সামনে বসা, নারীদের দিকে তাকানো—সবই এই হাদীসের বিরোধী।

🟢 রাস্তা নিরাপদ রাখতে হবে সকলের জন্য—বিশেষ করে নারীর জন্য।

নারীদের রাস্তার ধারে বসা, আড্ডা ও পর্দা লঙ্ঘন। সেখানে গল্পগুজব, আড্ডা, অনাবৃতভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা – এই কাজগুলো সরাসরি (কষ্ট দেওয়া) (গোপনীয়তা উন্মোচন) এর অন্তর্ভুক্ত।

“বাড়ির দরজার সামনে এমনভাবে বসা, যাতে গোপনীয় বিষয় উন্মুক্ত হয়ে যায়—তাও কষ্টদায়ক বস্তু।”

➡️মেয়ে বা নারীদের এই ধরনের বসা, গীবত, হিংসা, ফেতনা—এসব রাস্তার হক লঙ্ঘন এবং সমাজে ফিতনার উৎস।

রাসূল ﷺ বলেন:"তোমরা রাস্তার ধারে বসে থেকো না..."।

❌ নারীদের রাস্তার আড্ডা, গীবত ও পর্দাহীনতা = ইসলামী আদব লঙ্ঘন

 

🌸২.পুরুষদের রাস্তার দখল, আড্ডা ও জনদুর্ভোগ:

🔹পুরুষেরা যদি বাজার, মোড়, রাস্তার মাথায় বা চায়ের দোকানের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয় —

➡️ এতে পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, নারীরা চলতে ভয় পায়, যানজট সৃষ্টি হয়।

➡️ এটি সরাসরি রাসূল ﷺ-এঁর নিষিদ্ধকৃত... (রাস্তায় বসা)-এর অন্তর্ভুক্ত।

🔹 রাসূল ﷺ বলেছিলেন:

“তোমরা যদি বসতেই চাও, তাহলে রাস্তার হক আদায় করো।”

📚 সহীহ মুসলিম: ৫৭৭২

রাস্তার হক মানে কেবল “চোখ নামিয়ে রাখা” নয়—

➡️ বরং রাস্তাকে উন্মুক্ত রাখা, কষ্ট না দেওয়া, দৃষ্টি সংযত রাখা, কোনো হিংসা বা অনৈতিকতা জন্ম না দেওয়া—সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

❌ পুরুষদের রাস্তায় জমে থাকা, আড্ডা, যানজট = সামাজিক কষ্ট ও রাস্তার অন্যায় দখল

 

---

🌟ইবনে আবি যিনাদ বলেন:

যিনি হিজরি ১৩০ সালের দিকে মাদীনায় ছিলেন এবং ইমাম মালিকের যুগের একজন বিশ্বাসযোগ্য মুহাদ্দিস ও বর্ণনাকারী — তার একটি আসার।

“রাস্তার হক আদায়কারীরা রাসূলের সত্যিকার অনুসারী; তারা চক্ষু সংযম, সালাম, উত্তম কথা ও সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।”

(আবু নুয়াইম আল-ইসফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়াঃ

➡️খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ২৫৮), ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, হাদীস নং: ১৭৫১ (তাহকীক সহ) 📘আল-মুয়াত্তা ইমাম মালিক, তাখরিজ: মুহাম্মদ ফুয়াদ আব্দুলবাকী।

✅ শু’আবুল ঈমান – ইমাম বায়হাকী, হাদীস: ১০৩৯০, 📘 [মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, খণ্ড ১১, হাদীস নম্বর:  আবি সায়বা-25857]

---

   🌟আল-ফুদাইল ইবনু আইয়াদ (রহ.) বলেন:

🌸“তুমি যখন রাস্তায় বসে থাকো, মনে রেখো তুমি দায়বদ্ধ — যেন কোনো পথিক তোমার থেকে কষ্ট না পায়, এমনকি তোমার চোখ থেকেও না।”

📘 [সিফাতুস্ সফওয়া, ৪/১৩৪]

📚 রেফারেন্স (নির্ভরযোগ্য সূত্র):▪ [বইয়ের নাম: "মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা"

▪ খণ্ড: ৫, ▪পৃষ্ঠা: ২৭৮, ▪ হাদীস নম্বর: ২৫৮৫৭]

 

---

   📌 🌟ইমাম ইবনুল জাওযী (রহ.) বলেন:

🌸“রাস্তা হলো মানুষের মিশ্রস্থল বা একত্র হওয়ার স্থান। সুতরাং সেখানে যদি কোনো অশ্লীলতা বা মন্দ কাজ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার পাপের বোঝা সবার উপর বর্তায়।”

[রেফারেন্স: গ্রন্থ: সাইদুল খাতির, প্রকাশ: দারুল ফিকর, পৃষ্ঠা: ৫৭৩]

🔍 প্রাসঙ্গিক হাদীস:

❝তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন তা নিজের হাতে প্রতিরোধ করে। যদি না পারে, তবে তার ভাষায় (কথায়) প্রতিবাদ করুক। যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করুক—এটাই ইমানের দুর্বলতম স্তর।❞

— সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৯

📗ব্যাখ্যা:

রাস্তা ও জনসমাগমস্থল হচ্ছে মানুষের চলাফেরার প্রধান কেন্দ্র। সেখানে যা ঘটে তা সমাজে প্রভাব ফেলে।

যদি কেউ খারাপ কিছু করে, আর অন্যরা তা জানার পরও চুপ থাকে, প্রতিবাদ না করে বা প্রতিরোধ না করে—তবে সকলেই সেই গোনাহের ভাগীদার হয়ে পড়ে।

---

🌟উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন___

 🌸“আমি অপছন্দ করি এমন রাস্তা, যেখানে মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারে না।”,

“রাস্তা যেন মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার স্থান হয়, ভয়ের নয়।”অথবা

"যদি কোনো পশুও হোঁচট খায় রাস্তার কারণে, তবে আমি আশঙ্কা করি, কিয়ামতের দিন আমাকে (উমরকে) জিজ্ঞাসা করা হবে।”

📌 ব্যাখ্যা: রাস্তার পরিবেশ এমন হতে হবে যেখানে মানুষ সম্মানের সাথে চলতে পারে।

 

📚 বাংলা রেফারেন্সসমূহ:

📘 [ ফুতূহ মিসর ও আখবারুহা — ইবন আবদুল হাকাম, পৃষ্ঠা: ১৩৭

📘 শু‘আবুল ঈমান — ইমাম বায়হকী, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৩৫৮, হাদীস: ৬৯৯৫

📘 তারীখে দিমাশক — ইবন আসাকির, খণ্ড: ৪৪, পৃষ্ঠা: ২৯৫

📘 সীর আ‘লামুন নুবালা — ইমাম যাহাবী, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ৩৮০

📘ইমাম গাযালী, খণ্ড ২, পৃ. ১১৬

📘ইবন আসাকির, খণ্ড ৪৪, পৃ. ২৯৫

📘 ইবন আবিল হাদীদ, খণ্ড ১২, পৃ. ৩৪৫]

📚 শু‘আবুল ঈমান, ইমাম বায়হকী_ খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ৯৯; হাদীস নং: ৭৫৫৪, সংস্করণ: হায়দারাবাদ ।

---

 🌟ইমাম মালিক (রহঃ)-এর বাণীঃ

🌸 ❝প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বসা একটি নিন্দনীয় বিদআত। এতে ক্ষতির পরিমাণ উপকারের চেয়ে বেশি।❞

📚 বাংলা রেফারেন্স:

📘 গ্রন্থ: আল-মুদাওয়ানাহ আল-কুবরা। 📖 লেখক: ইমাম মালিক ইবন আনাস রহঃ। 📘 খণ্ড: ২, 📄 পৃষ্ঠা: ২৪৩

📍 সম্পাদনা: সাযিদা ইবনে হাবীবের রেওয়ায়েত অনুযায়ী।

---

 🌟 ইবনে সিরীন (রহঃ):

🏷বিষয়: রাস্তায় বসা ও নিরাপত্তাঃ

“তারা (সালাফগণ) রাস্তার ধারে বসা অপছন্দ করতেন এবং বলতেন: ‘এটা নিরাপদ নয়, এমন কেউ পাশ দিয়ে যেতে পারে যার ধর্ম বা আচরণে তুমি সন্তুষ্ট নও।”

📚রেফারেন্স:

📘 সীর আ‘লামুন নুবালা, ইমাম শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহঃ), খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৬০০,প্রকাশনা: বৈরুত, লেবানন।

📘মাওসু‘আতু আথারিস সালাফ।, বিষয়: সালাফদের জীবনাচার, হিকমা ও সামাজিক আদব, সংকলক: দার আল-ওয়াতান, উদ্ধৃত হয়েছে: ইবনু সিরীন-এর বর্ণনায়।

---

📝ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ:

এই ব্যাখ্যা আমাদের শিক্ষা দেয় যে:

কষ্টদায়কের সংজ্ঞা শুধু পাথর, কাঁটা, বা শব্দ নয় — বরং এমন আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি বা উপস্থিতিও কষ্টদায়ক, যা কারো মনে ভয় বা অসম্মান তৈরি করে।

মানসিক কষ্ট ও সামাজিক হুমকিও বা কষ্টরূপে গণ্য — ইসলাম বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয়ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।

রাস্তার ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার মানে অন্যের মনোবল ভেঙে দেওয়া নয়, বরং সম্মান, নিরাপত্তা ও স্বস্তি প্রদান।

নারীদের প্রতি দৃষ্টি সংযত রাখা।

রাস্তায় চলাচলকারী কাউকে কোনো কথা বা কাজ দ্বারা কষ্ট না দেওয়া।

যারা সালাম দেয়, তাদের সালামের উত্তর দেওয়া।

ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া।

মন্দ কাজ দেখলে বাধা দেওয়া।

---

🌿 হাদীস থেকে শিক্ষা:

✅রাস্তার উপর বসা নিষিদ্ধ, যদি না হক আদায় করা হয়।

✅দৃষ্টি সংযত রাখা রাস্তার অন্যতম হক।

✅কাউকে কষ্ট না দেওয়াও রাস্তার হক।

✅সালামের উত্তর দেওয়া ইসলামী আদবের অংশ।

✅সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ রাস্তার কর্তব্য।

✅একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহি নীতি:

❝ক্ষতি প্রতিরোধ কল্যাণ আনার চেয়ে অগ্রগণ্য।❞

রাস্তার উপর বসা নিষিদ্ধ হলেও তা হারাম নয়, বরং নিরুৎসাহিত বা মাকরূহ;

কারণ সাহাবিরা যদি বুঝতেন এটি হারাম, তবে প্রশ্ন করতেন না বা তর্ক করতেন না।

---

📌শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:

✅ রাস্তা মানুষের সম্মিলিত সম্পদ, সেখানে আদব রক্ষা জরুরি।

✅ সালামের জবাব, চক্ষু সংযম, অন্যকে কষ্ট না দেওয়া— ইসলামের মৌলিক নৈতিক শিক্ষা।

✅ রাস্তার উপর বসা হলে ইসলামের সামাজিক দায়িত্ব পালন আবশ্যক।

✅ রাসূল ﷺ মানুষের নৈতিকতা, সৌজন্যবোধ ও সম্মান রক্ষার প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন।

✅ এ হাদীস থেকে দাওয়াহ, সামাজিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।

✅যে আচরণ অন্যকে ভয় পাইয়ে দেয়, তা থেকেও বিরত থাকা রাস্তার হকের অংশ।

✅ইসলাম শুধু বাহ্যিক কাজ নয় — হৃদয়ের গুণাবলিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখায়। 

 

---

🌿 উপকারিতা (সংক্ষেপে):

রাস্তার হকের মধ্যে শুধু কষ্ট না দেওয়া বা দৃষ্টি সংযত রাখাই নয়, বরং পথহারা কাউকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া একটি ইবাদত।

এটি সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহায়তার নিদর্শন।

এটি “সাদাকাহ” হিসেবেও গণ্য হয়, যেমন হাদীসে এসেছে:

"তোমার ভাইকে পথ দেখানো – সাদাকাহ।"

📝 উপসংহার:

এই হাদীসটি আমাদের সমাজে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। রাস্তার আদব, সম্মান ও শান্তির জন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রাস্তার হকসমূহ জানা ও তা পালন করা।

রাস্তার হক শুধু শহরের নিয়ম বা ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ নয়—এটা ইসলামের অংশ। একজন মুমিন ব্যক্তি রাস্তার ধারে বসলে, তাকেও রাস্তার অধিকার আদায় করতে হবে। নয়তো তা হবে গুনাহের কাজ। তাই আমাদের উচিত রাস্তার হক যথাযথভাবে আদায় করা এবং ইসলামি মূল্যবোধ অনুসারে সমাজ গঠন করা।

রাস্তা হলো পরীক্ষার ময়দান — সেখানে চোখের হেফাজত, আচরণের সৌজন্য, শব্দের সংযম এবং অন্তরের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

যদি আমরা রাস্তায় রাসূল ﷺ-এর শিক্ষা অনুসারে চলি, তবে এই সমাজ হবে আরো শান্তিপূর্ণ, নারীর চলাচল হবে নিরাপদ, শিশুরা পাবে উদাহরণ, এবং মুসলিম পরিচয় হবে মর্যাদার।

রাস্তা ব্যবহারে সংযম, ভদ্রতা ও ইসলামী আদব রক্ষা করা শুধু সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য নয়, বরং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমও বটে।

 

📌 মনে রাখুন:

রাস্তা আমার সুবিধার জায়গা নয়, বরং আমার দায়িত্বের জায়গা।

 

🌿 গ্রামাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে: রাস্তার হক ও সমাজে ফিতনা

🌿 বাস্তব চিত্র (গ্রামাঞ্চল)

আজকাল গ্রামাঞ্চলে একটি খুবই দুঃখজনক চিত্র দেখা যায়:

🔹নারীরা রাস্তার ধারে বা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে আড্ডা দেয়,

🔹সেখানে চলে গীবত, পরচর্চা, হিংসা ও করুণ পরনিন্দা,

🔹অনেক সময় পর্দাহীনভাবে বসে থাকে—নেই হায়া, নেই চোখ নামানোর পরিবেশ,

🔹অন্যদিকে, পুরুষরাও রাস্তার মোড়ে, দোকানের সামনে বা বাজারে আড্ডা দেয়,

🔹এতে রাস্তায় চলাচলের বিঘ্ন, ফিতনা, ও মানবিক কষ্ট সৃষ্টি হয়।

 

🌿 রাস্তার হকের আলোকে এইসব কাজের মূল্যায়ন:

🕋 হাদীস:“তোমরা রাস্তার ধারে বসে থেকো না।”

তারা বলল, “আমরা তো গল্পগুজবের জন্য বসতেই হয়।”

তিনি ﷺ বললেন: “তাহলে রাস্তার হক আদায় করো।”

তারা বলল: “রাস্তার হক কী?” তিনি বললেন:

“চোখ নামিয়ে রাখা, কষ্ট না দেওয়া, সালামের জবাব দেওয়া, সৎ কাজে আদেশ এবং মন্দ থেকে নিষেধ করা।”

📚 সহীহ মুসলিম: হাদীস ৫৭৭২; সহীহ বুখারী: ২৪৬৫

🌿 ইসলামী মূল্যায়ন ও শিক্ষণীয় বিষয়:

✅ নারীদের রাস্তার ধারে বসা, গল্পগুজব, গীবত, এবং পর্দাহীনতা — এটি রাস্তার হক লঙ্ঘন এবং সমাজে ফিতনা সৃষ্টির মাধ্যম।

✅ পুরুষদের আড্ডা, রাস্তার দখল, যানজট সৃষ্টি — এটিও শরীয়তসম্মত নয়, এবং রাসূল ﷺ এর স্পষ্ট নিষেধের পরিপন্থী।

✅ রাস্তা হচ্ছে মানুষের অধিকারপূর্ণ জায়গা, এটি দখল বা গীবতের মজলিস নয়।

✅ উপসংহার:

ইসলামের দৃষ্টিতে রাস্তা হলো মানুষের নিরাপদ চলাচল, চোখ সংযম, সামাজিক শিষ্টাচার ও দাওয়ার স্থান।

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এই হক আদায় করা ফরয, যাতে ফিতনা বন্ধ হয়, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

---

🌿 রাস্তার হকসমূহ(বিষয়ভিত্তিক তালিকা):

---

বাংলা অনুবাদ	রেফারেন্স	সালাফদের ব্যাখ্যা
দৃষ্টি সংযত রাখা	বুখারী ২৪৬৫, মুসলিম ৫৬৪৮	ইবনু রজব (রহ.) বলেন: "তোমার চোখ যেন কাউকে অপমান না করে, যেন ফিতনায় না পড়ে।" (ফতহুল বারি)
পথচারীদের কষ্ট না দেওয়া	মুসলিম ৫৬৪৮, আবু দাঊদ ৪৯১৭	ইমাম নাওয়াবী (রহ.) বলেন: "গীবত, খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি, শব্দদূষণ, গালাগাল, পথ আটকে রাখা—সবই কষ্টদানের অন্তর্ভুক্ত।" (শারহু মুসলিম ১৪/১১২)
সালামের উত্তর দেওয়া	বুখারী-মুসলিম	সালাফগণ বলতেন: “সালাম ফিরিয়ে না দিলে অন্যায়ের দায় থেকে মুক্তি নেই।” (আদাবুল মুফরাদ)
ভালো কাজে আদেশ করা	মুসলিম ৫৬৪৮	ইবনে তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন: “রাস্তার মুসলিম ভাইকে গাফিল দেখলে উপদেশ দেওয়া — ইমানের দায়িত্ব।”
মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা	মুসলিম ৫৬৪৮	হাসান আল বাসরী (রহ.) বলেন: “যে দেখে কিন্তু নিষেধ করে না, সে নিজেও দায়ী।”
পথ হারানোকে পথ দেখানো	আবু দাঊদ ৪৯১৭, সিলসিলাহ ২৪২১	আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রহ.) বলতেন: "এটি সাদাকাহ।" (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা)
বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা	মুসনাদ আহমাদ-১২৫৫৪	উমার (রাঃ) বলতেন: "একজন অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো হলো জিহাদের ন্যায়।"
হাঁচি দেওয়া ব্যক্তিকে 'ইয়ারহামুকাল্লাহ' বলা	আবু দাঊদ ৫০৩২	সালাফগণ এটিকে সামাজিক সৌজন্য বলতেন
মাযলূমকে সাহায্য করা	আবু দাঊদ ৪৯১৭, বায়হাকী ৪২৪৪	উমার (রাঃ) বলতেন: “মাযলূমের পাশে না দাঁড়ানো জুলুমে অংশ।”
রাস্তায় আল্লাহর যিকর করা।	তাবারানী, মুসান্নাফ আব্দুর রায্জাক	সালাফগণ বলেন: "রাস্তা ফিতনার স্থান, তাই তা যিকর দ্বারা শুদ্ধ করো।"

 

🌸🌸rasikul india

🌸ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা