নোমান আলি খান কর্তৃক সাহাবিদের উপর অপবাদ ও তার জবাব! (পর্ব-০২)

নোমান আলি খান কর্তৃক সাহাবিদের উপর অপবাদ ও তার জবাব! (পর্ব-০২)

নোমান আলী খান নিয়ে আমাদের পেজে যে দুইটি পোস্ট প্রকাশিত হয়েছিলসেই ব্যাপারে বেশ বিতর্ক হয়েছেঅনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করেছেন,কেউবা কমেন্ট বক্সে গালি ছুড়েছেন!
যাহোকমানুষ ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারে। তবে ভিন্নমত পোষণ করলে দলিল সহকারে করা উচিত। সাহাবী-সাহাবিয়াতরা দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কো-ওয়ার্ক করেছেনবিজনেস পার্টনারশিপ করেছেনএকে-অপরকে প্রস্তাব দেওয়ার সময় খুব ক্যাজুয়ালি, “hey, I like you” জাতীয় কথাবার্তা বলেছেনকিংবা বিয়ের আগে বেশ ভালো সময় নিয়ে “রেসপেক্টফুল কোর্টশিপ” করে মন দেওয়া-নেওয়া করেছেন! এরকম কোনো প্রমাণ কেউ দেয় নি।
একজনকে দেখলাম লম্বা একটা নোট লিখেছেন তাদের কথিত উস্তায কে ডিফেন্ড করতে যিনি লিখেছেন তিনি একাধিক দলিল দিয়ে দুটো বিষয় খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন!
১. সাহাবিরা সাহাবিয়াতদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।

২. বিয়ের আগে তারা প্রসপেকটিভ স্পাউস এর চেহারা দেখেছেন।

সমস্যা হচ্ছেবিতর্ক এই বিষয়ে না। একজন সাহাবীসাহাবিয়াতকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেনবিয়ের আগে চেহারা ভালো করে দেখে নিয়েছেনবিতর্ক এটা নিয়ে না। অবশ্যই একজন মুসলিম পুরুষ একজন মুসলিম নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেনতার চেহারা দেখে নিতে পারেনএমনকি তার সাথে কথাও বলতে পারেন। আমি জানিনা তিনি এই দলিলগুলো দিয়ে আসলে কী প্রমাণ করতে চেয়েছেন। বিতর্ক হলো সাহাবিরা সাহাবিয়াতদের সাথে ক্যাজুয়ালি মেলামেশা করেছেনদীর্ঘ পরিচয় ছিলোতারপর তারা খুব ক্যাজুয়ালি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন (যেটা জাহিলরা করে থাকে) -- এই কথাগুলো নিয়েচেহারা দেখা বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে না।

বিয়ের আগে প্রস্পেকটিভ স্পাউসদের মধ্যে কেমন ইন্টারএ্যাকশন হবে সেটা ইসলামে বেশ স্ট্রিক্ট। যেমন- মাহরামের উপস্থিতিতে কথাবার্তা বলা।

ভাই ও বোনেরানিজেদের সাথে সৎ হোন। “নিজেদের মধ্যে চেনাজানা” হওয়া বলতে আমরা যেটা বুঝিসেটার সুযোগ ইসলামে কি লাগামছাড়া ভাবে আছেনিজেদের মধ্যে “চেনাজানা” হতে মানুষ আজকাল বছরের পর বছর লাগিয়ে দেয়। মাহরামের সামনে বসে দুই-চার বৈঠকে আর যাই হোক, “চেনাজানা” হয় না। হ্যাঁঅবশ্যই ইসলাম আপনাকে অনুমতি দেয় আপনি প্রস্পপেক্টিভ স্পাউসের সাথে কথা বলবেনকিন্তু প্রচলিত সেন্সে “চেনাজানা” হওয়া যেটা বুঝায়সেটার কাছেধারেও আমরা এমন কোনো কাহিনী সাহাবীদের মধ্যে পাই না। সে যুগটা ছিলো এমন যে “মেয়েদের নীরবতাকেই সম্মতি হিসেবে দেখা হতো।” এই যুগ বদলেছেতার মানে এই নয় যে ইসলামের নীতিগুলোও বদলে যাবে।


আর অনেকেই বলছেন প্যারেন্টাল গাইডেন্সের কথা। আমরা যখন একটা কথা বলিতখন আসলে কথাগুলো প্রচলিত সেন্সকে মাথায় রেখেই বলি। আমাদের এই সময়ে যখন ফ্রি-মিক্সিং এর বিষয়টাকে মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেতখন বিয়ের কথা উঠলে প্যারেন্টাল গাইডেন্সটা কেমন হয়? “তোমরা বসে গল্প করোআমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।” এই যদি প্যারেন্টাল গাইডেন্সের স্ট্যান্ডার্ডআর তারপর যদি বলা হয় “কোর্টশিপ” রেসপেক্টফুল হলে কোনো সমস্যা নাইতাহলে ফিতনার দরজা কি খুলে যায় না?

আমাদের প্যারেন্টসরা কয়জন ইসলামী নিয়মনীতিগুলো কঠোরভাবে মেনে চলেন যে প্যারেন্টাল গাইডেন্স এর হাতে বিষয়টা তুলে দিয়ে এত সিরিয়াস একটা বিষয়কে হালকা বানিয়ে ফেলা যায়নোমান আলী খান নিজেই এই লেকচারে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে নাসিহা দিয়েছেকেনকারণ অভিভাবকদের বুঝে সমস্যা আছেঅথচ পরবর্তীতে তিনি নিজেই বিষয়টাকে “প্যারেন্টাল গাইডেন্সের” হাতে ছেড়ে দিলেনএই পরিস্থিতিতে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করলেন নাপুরো বিষয়টাকে জোকস করে হালকা করে ফেললেন। অথচ প্রশ্নকর্তা খুব স্পষ্টভাবে বিয়ের প্রস্তাবের সময় ইসলামের নীতিমালাগুলোই জানতে চেয়েছিল।


দলিল দেখাতে না পারলেওঅনেকে এমন দাবি করেছেন যে “হেইআই লাইক ইউ” টাইপ কথা বলা নাকি ওয়েস্টার্ন কালচারওয়েস্টার্ন অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখেই উনি এভাবে বলেছেনএটাতে তারা কোনো সমস্যা পান নি।


দীর্ঘদিন যাবৎ লন্ডনে থাকা এক দ্বীনী বোন বলেছেন- এই লন্ডনের কালচারেও যদি কেউ কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য “হেইআই লাইক ইউ” বলেসেটা আর যা-ই হোককোনোভাবেই মার্জিত আচরণ না। কথাটা শুনতে হয়ত “cool” লাগতে পারেকিন্তু এটা কোনোভাবেই Dignified আর Respectful attitude হিসেবে এখানেও গণ্য হয় না। আর একজন সাহাবী আরেকজন সাহাবিয়াতকে এরকম অসভ্যের মতো প্রপোজ করেছেন এটা চিন্তাই করা যায় না। কারো কাছে যদি এই টাইপ কথাবার্তা খুব “নরমাল” মনে হয়তাহলে বুঝতে হবে যেপশ্চিমা নির্লজ্জতার কালচারে সে এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যেমার্জিত আচরণ আর শিষ্টাচার কী জিনিস সেটাই সে জানেনা। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিইএটাই বিদেশী কালচারতবু শরীয়াহর নিয়ম উরফ বা প্রথার ওপর প্রাধান্য পাবে। অনেকের কথা শুনে মনে হচ্ছেআমরা যারা বিষয়টার প্রতিবাদ করছিতারা যেন ইংলিশ ভাষাও ঠিকমতো বুঝি না বা ওয়েস্টার্ন কালচার সম্পর্কে ধারণা নেই।


এই লেকচারে নোমান আলী খান একটা ভয়াবহ আপত্তিকর কথা বলেছেনযেটা অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। সে বলেছে, “তোমার মেয়েরা যদি ঘরে বসে থাকেতাহলে কে তাকে পছন্দ করবে?”
এভাবে চিন্তা করে বাংলাদেশের ট্রেডিশনাল কিছু মহিলা। মেয়েকে বিয়ের বাজারে তোলার জন্য তারা মার্কেটেবিয়েবাড়িতে যাবার আগে ভালো করে একটু সাজিয়ে-গুজিয়ে নেয়যেন সুপাত্রের “চোখে পড়ে যায়”। সুবহানআল্লাহইসলাম এই কথা কবে বললোকোথায় বললোকার মুখ দিয়ে বললো যে মেয়েদের ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে যেন পাত্ররা তাদের বিয়ের জন্য পছন্দ করেমেয়েদের ঘরের বাইরে কাজ করার যে ফেনোমেনাএটা খুব পুরোনো নয়। তার আগে কি বিয়ে হতো নাআমাদের ট্রেডিশনাল ফ্যামিলিগুলো মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অনেক অযাচিত বাড়াবাড়ি করে সেটা সত্যিকিন্তু তার মানে কি এটাযে বাইরে ছুটে পুরুষদের সামনে ঘুরঘুর করতে হবে?

এই কথার ইমপ্লিকেশন আপনারা কি ভেবে দেখেছেনমেয়েদেরকে কো-এডুকেশন স্কুলে যেতে হবেপুরুষ সহকর্মীদের সাথে কো-ওয়ার্ক করতে হবেএসব না করলে তার বিয়ে হবে নাআগে জানতামপ্রয়োজন ছাড়া মেয়েদের ঘরের বাইরে কাজ না করাই উত্তমএখন দেখছি বিয়ের বাজারে নিজেকে ওঠানোর জন্য কো-ওয়ার্কিং শুরু করতে হবে! সুবহান আল্লাহযখন প্রয়োজন ছিল কো-ওয়ার্কের ফিতনা থেকে বোনদের সতর্ক করাযখন দরকার ছিল বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর “চেনাজানার” নামে যতো প্রেম-প্রীতি হয়ফিতনা হয়সেসবের ব্যাপারে বেশি বেশি সতর্ক করাসেসব না করে নোমান আলী খান এটা কীসের লাইসেন্স দিলেনঘরের বাইরে কাজ করোসহকর্মীদের সাথে পরিচিত হওকথা বলোসময় নিয়ে কোর্টশিপ করো -- এটাই কি ইসলাম শিক্ষা দেয় নারীদের?

নোমান আলী খানের ভালো ভালো কাজকে আমরা অস্বীকার করছি না। কেনই বা করবযখন আমি নিজে তার লেকচার দিয়ে উপকৃত হয়েছি। আমার জীবনের ইসলামের সূচনা যাদের হাত দিয়ে আল্লাহ করেছেন তাদের মধ্যে এই নৌমান আলী খান একজন। কিন্তু আমার ভালোবাসাআমার আলটিমেট লয়ালটি দ্বীনের প্রতিব্যক্তি নৌমান আলী খানের প্রতি নয়। কোনো মুসলিমই কোনো ব্যক্তিকে দ্বীনের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে পারে না।

আমরা নবী ও সাহাবিদের ব্যাপারে খুব সাবধানে কথা বলি। মূসা আলাইহিস সালামের স্ত্রী মূসাকে পছন্দ করেছিলেন -- এরকম কোনো উক্তি আজ পর্যন্ত কোনো মুফাসসির করেছেন বলে আমার জানা নেই। যদি পছন্দ করেও থাকেনআমি নিশ্চিতশুধুমাত্র সম্মান আর মর্যাদার কথা মাথায় রেখে কোনো মুফাসসির এই ধরণের একটা অনুমান করা থেকে বিরত থেকেছেন। আর সেখানে নোমান আলী খান কুরআনের আয়াত থেকে এই ব্যাখ্যা পেলেন কোথায়তবুও যদি ভদ্রতা আর সৌজন্যবোধ বজায় রেখে কথাটা বলতেনতাহলে একটা কথা ছিলো। একজন নবীর স্ত্রীর ব্যাপারে এত ক্যাজুয়ালি কথা বলা কি আল্লাহর রাসূল আমাদের শিখিয়েছেন? He’s kinda a nice guy -- এটা কোন ধরণের সম্মানকী প্রয়োজনই বা ছিলো তাঁর ব্যাপারে এই টোনে কথা বলারহাততালি আর হাসির রোল ছাড়া কী মিলেছেওয়েস্টের মুসলিমরা কি এতোই বুদ্ধিহীন যে নবী আর সাহাবাদের ব্যাপারে কথা বলার সময়ও ফানিভাবে কথা বলতে হবেঅভিনয় করে করে দেখাতে হবে?
সময়ের সাথে সাথে আমরা নোমান আলী খানকে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখেছি। তার একটা লেকচারের দুটো লাইন শুনে বা একাংশ শুনেই আমরা তার সমালোচনা করি নি। ফ্রি মিক্সিং একটামাত্র ইস্যু না। এরকম আরো অনেক কিছুই আছে। যখন কোনো দ্বীনের দায়ীর কাছ থেকে এই ধরণের ভুল বার বার হতে থাকেআর ভুলের মাত্রা বাড়তেই থাকেসেটা তার অজ্ঞানতার কারণে হোকইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোকসেই বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করাটা গীবতের পর্যায় পড়ে নাবরং দায়িত্ব-কর্তব্য হয়ে যায়। যারা ইসলামের এলিমেন্টারি লেভেলটা শেষ করেছেনতারা খুব ভালো করেই জানেন কখন গীবত করা হালাল হয়। দুঃখজনক ভাবেঅনেককেই দেখা যায়অপছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেদারসে কথা বলে যাচ্ছেআর পছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা শুনলেই শোরগোল তুলতে থাকে “গীবতগীবত করে!”

অন্যের অনুপস্থিতিতে তার দোষ বা ভুল বর্ণনা করা কখন প্রয়োজনীয় বা অনুমোদিত হয়ে যায়সেটা জানতে চাইলে সোজা চলে যান ইমাম নববীর (রাহিমাহুল্লাহ) বিখ্যাত বই রিয়াদুস স্বলেহীনে। সেখানে ক্যাটাগরি উল্লেখ করে বিষয়টা আলোচনা করেছেন।


হাদীস শাস্ত্রের একটা বড় অংশই হচ্ছে বর্ণনাকারীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা নিয়ে। সেখানে একজন দাঈ প্রকাশ্যে ভুল করলেতার সমালোচনা করা যাবে নাএটা হতে পারে না। এই সমালোচনা ব্যক্তি-আক্রমণ নয়বরং এটা দ্বীনের জন্য জরুরি। নোমান আলী খানের ব্যাপারে একাধিক আলেম ও শাইখ সমালোচনা করেছেনসতর্ক করে দিয়েছেন। এমনকি নোমান আলী খানকে অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে নাসীহা দিয়েছেন।

শেষ কথা,

বিয়ের আগে ফ্রি-মিক্সিংচ্যাটিং ইত্যাদি এই ইস্যুগুলো নিয়ে আলিমগণের বিস্তারিত আলোচনা আছেএবং তারা স্পষ্ট করেছেন যে বিয়ের আগে নারী ও পুরুষের মেলামেশায় নির্ধারিত সীমা আছে। যেই কাহিনীর কথা (মুসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম এর বিয়ে) এই লোক বা তার মতো অন্যান্যরা বলছে আলিমরা সেটা সম্পর্কে অনবহিত ছিলেনএমন না।”

আমরা কেন নোমান আলী খানের সমালোচনা করছিসে বিষয়ে যদি কেউ আন্তরিকভাবে জানতে চানতাদের জন্য দুটো ভিডিও লিংক দেবো (কমেন্ট দ্রষ্টব্য)। আশা করি এটার জন্য সময় খরচ করার মানসিকতা তাদের আছে। ভিডিওটা শাইখ আবু মুসসাব ওয়াজদি আল আক্কারির। তিনি নিজেই একসময় নোমান আলী খানের লেকচার শোনার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিতেন। পরবর্তীতে তিনি তার ভুলগুলো দেখে তাকে ব্যক্তিগত ভাবে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু এরপরেও কোনো সমাধান না হওয়ায় উম্মাহকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে কিছু কথা সরাসরি বলা জরুরি মনে করেছেন।

সবশেষে এটাই বলবজীবিত মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারেকেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আর নোমান আলী খানের মত এত পরিচিত একজন দায়ীযার লক্ষ লক্ষ অডিয়েন্সসে যদি ইসলামের বেসিক বিষয়গুলো নিয়ে বার বার ভুল করতে থাকেতাহলে সাবধান হতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর দ্বীনের চাইতে দামী আর কিছুই নেই।

পশ্চিমা দেশের অসংখ্য ভ্রান্ত বক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নোমান আলী খান।
নোমান আলী খানের হাদীস ছাড়া কুরআনের তাফসীর কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
@@বিষয়ঃ ‘নোমান আলি খান’ কে নিয়ে প্রশ্নের উত্তর।